বাংলা ভাষা চর্চায় ইংরেজির ব্যবহার

1 min read

বাংলা ভাষার লেখালেখি চর্চায় বাংলা হরফে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার মনকে নাড়া দেয়। আপাতভাবে বিষয়টি হয়তো গুরুতর নয়, কিন্তু বাংলা লেখায় ইংরেজি শব্দের ওপর এই নির্ভরশীলতা কি বাংলা ভাষার স্বনির্ভরতার পরিপন্থী নয়? উদ্বেগটা এখানেই। বাংলা গল্পকারদের গল্প লিখতে গিয়ে গল্পের প্রয়োজনে অনেক সময় চরিত্রের মুখনিঃসৃত সংলাপ ব্যবহার করতে হয়। আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, মুখনিঃসৃত বাংলা বাক্যে খুব দরকারে বহুল ব্যবহৃত সহজবোধ্য ইংরেজি শব্দ জায়গামতো বসিয়ে দিই। কথ্য বাংলা ভাষায় এমন টুকরো টুকরো ইংরেজি শব্দের ব্যবহার হয়তো অতটা উদ্বেগজনক নয়, যতটা উদ্বেগজনক লিখিত বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। ঠিক সেই কারণেই বাংলা গল্পকার যখন চরিত্রের মুখনিঃসৃত সংলাপে বাংলা হরফে দু-একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন, তা বাস্তবতার নিরিখে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু সংলাপের বাইরে গল্পের বাকি যে অংশ, তা তো গল্পকারের কলম-নিংসৃত বাংলা। সেই বাংলায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার তো শূন্যপ্রায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। শব্দের সুবিশাল ভান্ডার নিয়ে বাংলা ভাষা কি যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয় যে সহজবোধ্য বাংলা শব্দের উপস্থিতি সত্ত্বেও ঐ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যবহার করার দরকার হয়ে পড়ে? স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, কিছু কথা নিশ্চয়ই আছে, যেগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দ এতটাই বহুল ব্যবহৃত যে কথাগুলো শুদ্ধ বাংলায় ঠিক কী, তা অনেকেই জানেন না। উদাহরণস্বরূপ ‘চেয়ার’ শব্দটি আদতে ইংরেজি শব্দ হলেও বাংলায় এর ব্যবহার এতটাই সাবলীল যে শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ ‘কেদারা’ বিনা ব্যবহারে অবলুপ্ত প্রায়। কিন্তু এরকম উদাহরণ হাতে গোনা, অথচ সহজবোধ্য বাংলা শব্দের জোরদার উপস্থিতি সত্ত্বেও ঐ শব্দের বদলে তার ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যবহারের প্রবণতা বিস্তর লক্ষণীয়। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে এবং বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যেসব লেখকেরা বাংলায় লেখেন, তাঁরা যদি খুব সতর্ক হয়ে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার যথাসম্ভব বর্জন করে চলেন, বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান জানানো হয় তখনই। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা লেখার মধ্যে বাংলা হরফে টুকরো টুকরো সহজবোধ্য ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে দোষ নেই, এমন মতবাদের স্বপক্ষে লেখকেরা যুক্তি দেবেন যে সহজতর পথে পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতেই জায়গাবিশেষে ইংরেজি প্রতিশব্দের ব্যবহার দোষের কিছু নয়। কিন্তু যিনি বাংলায় লেখেন, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর একটি দায়বদ্ধতা থেকেই কিন্তু তাঁর শপথ নেয়া দরকার যে ইংরেজির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থে শূন্য না হোক, শূন্যপ্রায় যেন অতি অবশ্যই হয়। ভাষাটিকে ভালোবেসেই ভাষাটিকে প্রকৃত অর্থে স্বাবলম্বী করে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে লেখকদেরকেই।

প্রসঙ্গানুক্রমে একটি বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরা যাক। একটি বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্রের এক রবিবাসরীয় সংস্করণের গল্প বিভাগে প্রকাশিত‌ দুতিনটে গল্পের মধ্যে চোখ বুজে বেছে নেয়া একটি গল্পে গুনে গুনে ৪০টি ইংরেজি শব্দের উপস্থিতি পাওয়া গেল। ঐ বিভাগের জন্য গল্প চেয়ে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়, তাতে শব্দ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া হয় ১,৪০০ থেকে ১,৬০০। সরাসরি শব্দ গণনায় না গিয়ে যদি সর্বোচ্চ শব্দ সীমাকে ধরে নিয়ে হিসেব কষা হয়, তার মধ্যে সংলাপের জন্য ব্যবহৃত আনুমানিক ১০০টি শব্দকে হিসেবের বাইরে রাখলে, সংলাপ-বর্জিত অংশে গাণিতিক হিসেব অনুযায়ী ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দাঁড়াচ্ছে ৩ শতাংশের একটু নিচে। শুকনো পরিসংখ্যানের নিরিখে ইংরেজির এই ব্যবহার হয়ত ‘শূন্যপ্রায়’-এরই নামান্তর, কিন্তু অতি সহজবোধ্য বাংলা প্রতিশব্দের অস্তিত্বকে অনায়াসে তাচ্ছিল্য করে যেভাবে ঐ গল্পে ‘প্র্যাকটিস’, ‘জিরো’, ‘গার্জিয়ান’, ‘এক্স’, ‘ক্রুয়েলটি’, ‘পেন’, ‘সিট’, ‘অ্যানিম্যাল’ (বাংলায় যথাক্রমে ‘অনুশীলন’, ‘শূন্য’, ‘অভিভাবক’, ‘প্রাক্তন’, ‘নির্মমতা’ বা ‘নিষ্ঠুরতা’, ‘কলম’, ‘আসন’, ‘জীব’) এবং এরকম আরো কয়েকটি ইংরেজি শব্দকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, তা যেন বাংলা শব্দভাণ্ডারকে অসম্মান করার জন্য যথেষ্ট। এসব দেখলে মনে হয়, বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ, অর্থাৎ বাংলা ভাষা যথেষ্ট সাবলম্বী, কিন্তু ইংরেজি-নির্ভরতা থেকে যথাসম্ভব বেরিয়ে আসার শপথ নিতেই হবে বাংলা লিখিয়েদের। বাংলাভাষী হয়ে বাংলার মতো মিষ্টি ভাষাকে ভালোবাসতে হলে এই শপথগ্রহণ ভীষণ জরুরী। নাহলে এক এক করে বহু বাংলা শব্দ সীমিত থেকে অতি সীমিত ব্যবহারের ফলে লুপ্তপ্রায় দশা থেকে আরো নীচে নেমে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত দশায় পৌঁছে যাবে। অন্য ভাষার শব্দকে সাদরে গ্রহণ করতে গিয়ে নিজের ভাষার শব্দগুলোকে বিলুপ্ত করে দেয়া নিশ্চয়ই কাঙ্ক্ষিত নয়।

পরিশেষে বলি, বিষয়টি নিয়ে সুস্থ বিতর্কের অবকাশ নিশ্চয়ই আছে। বাংলা লেখার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বা পাঠকের কাছে আরো সহজে পৌঁছতে দরকার মতো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে দোষ কী, এই মতবাদের সমর্থনে গুচ্ছ গুচ্ছ যুক্তি থাকতেই পারে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা হলেও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বাংলা রীতিমতো একটি রাষ্ট্রভাষা। এক রাষ্ট্রভাষায় লিখতে গিয়ে তার নিজস্ব শব্দভান্ডারকে হেয় করে, অতি সহজবোধ্য শব্দের উপস্থিতি সত্ত্বেও, আরেকটি ভাষার সংশ্লিষ্ট শব্দকে টেনে আনা ঠিক কতখানি যৌক্তিকতা বহন করে, প্রশ্ন সেখানেই।

You May Also Like