সব গল্পের নাম হয়না

1 min read

১.

“আমার দেশ আমার গর্ব।” এমন একটা উক্তি সব জায়গায় সচরাচর দেখা যায়, আবার এটি শুধু উক্তিই নয় অনেকে এটা মনে প্রাণে মানেন। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, যেখানে সবাই ভাই ভাই, যেখানে অনেক মানুষ বিদেশ থেকে আসেন শুধুমাত্র এখানকার মানুষদের দেখতে। আমাদের দেশের অনেক মানুষ এই কথাটি খুব বেশি পরিমাণে মেনে থাকেন আবার অনেকে শুধুমাত্র স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন লোক দেখানোর জন্য মেনে থাকেন। কথাটা তেতো হলেও সত্য, ওই যে তেতো সবসময় সত্য হয় তেমনই। ঠিক তেমনই বিদেশ থেকে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মানুষকে দেখতে আসেন অনেকে তার কারণ অনেকেই জানেন না কিন্তু। তার আসল কারণ হলো আমাদের দেশের মানুষের ব্যাবহার, হুম ব্যাবহার। কোনো মানুষ কাউকে না চিনে না জেনেও আতিথেয়তা করে থাকেন তার মূল কারণ আমাদের অনেকেই জানেন না কিন্তু তার মূল কারণ হলো ভারতীয়দের হৃদয়, যা অন্যের দুঃখেও ব্যথিত হয়ে থাকে। একটা মানুষ রোদে গরমে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে জল, চা নিশ্চয় খাওয়াবেন। আবার আমাদের দেশেই এমন অনেক মানুষ আছেন যারা এসবের কিছুই করেন না, এই যে তারা ওই মানুষের দলের মধ্যে পড়েন তারা আমাদের দেশকে শুধু কয়েকদিন ই মাত্র ভালোবাসেন বাকি দিন গুলোতে ভালোবাসেন কী না সেটা তারাই ভালো জানেন। হয়তো ভালোবাসেন না তাই তো তাদের চোখের সামনে কোনো বাচ্চা কষ্ট পেলেও তাদের কোনো মায়াই হয়না।

২.

বাইরে থেকে অনেকে আমাদের মানুষদেরই দেখতে আসেন এটা অনেকে জানেন না যেমন তেমন আরো একটা কথাও হয়তো অনেকেই জানেন না বা অনেক মানুষজন বলেন যেটা সেটি হলো আমাদের দেশে একটা ছয় বছরের বাচ্চা অভাবের তাড়নায় চা এর দোকানে কাপ, ডিস ধোঁয়ার কাজ করলে তখন তাকে ‘শিশু শ্রমিক’ বলা হয় আবার সেই মানুষজনই একটা ছয় বছরের বাচ্চাকে যে কোনো সিরিয়াল, সিনেমাতে অভিনয় করে থাকে তাকে ‘শিশু শিল্পী’ বলেন। খুব আজব নয় কী ? অবশ্যই অদ্ভুত। যে বাচ্চাটা খেতে পাচ্ছে না বা তার পরিবারের মা, বাবা বা অন্য কেউ খুব বেশি অসুস্থ যে তাদের বাড়িতে দু মুঠো অন্নও পাচ্ছে না তাকে কেউ দেখতে আসবে না, বা কেউ সহানুভূতি দেখিয়েও একটু খাবারও দিতে আসবে না। সেই বাচ্চাটা যদি একটু পেট ভরানোর আশায় যদি একটা রাস্তার ধারের হোটেল বা অন্য কোথাও থেকে একটু খাবার চুরি করে তখন সেই বাচ্চাকে মারা হয়, বকা হয় আবার অনেকে তো পুলিশের কাছেও নিয়ে যান ,কেনো ? তার কারণ সেই বাচ্চাটা ভবিষ্যতে বড়ো চোর হবে। কথাগুলো এমন ভাবে বলেন তারা যেনো সবাই ভবিষ্যত দেখতে পান, তারা এতোকিছু করেন কিন্তু কেউ সেই বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করেন না যে সেই বাচ্চা কেনো খাবার চুরি করেছে। জিজ্ঞেস করলে তারা জানতে পারতেন যে বাচ্চাটা শুধুমাত্র নিজের জন্য চুরি করেনি, সেই বাচ্চার একটা পরিবার আছে, তার ছোটো ভাই বা বোন ক্ষুধাতে কাঁদছে, তার বাড়িতে খাবার নেই, কখনো হয়তো ভাতের ফ্যান খেতে পেয়েছে শুধু, কিন্তু তাও বাচ্চাটা নিজে অভুক্ত থেকে নিজের পরিবারের জন্য খাবার চুরি করতে যায় আর সে খালি হাতে মার খেয়ে বাড়ি ফেরে। সেই বাচ্চাটার দিকে কেউ ভালো করে তাকিয়ে দেখেন ? না দেখেন না, সে তো একটা বস্তির মতো পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে, ময়লা জামাকাপড় পরিধান করেছে, চুল আঁচড়ানো নেই, মুখে ময়লা লেগে আছে সেজন্য কেউ দেখে না। কিন্তু সেই ময়লা মাখা বাচ্চাটার মুখের দিকে ভালো করে দেখলে সেই বাচ্চাটার চরম হাহাকার বোঝা যায়, সেই বাচ্চাটার চোখদুটোর মধ্যে কষ্ট প্রতিফলিত হয়, তার মুখে একটা অসহায় ভাব স্পষ্ট থাকে। কিন্তু কেউ সেটা বুঝতে চান না। তখন সেই বাচ্চাটা নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য একটা চায়ের দোকানে বা একটা মিষ্টির দোকানে বা একটা হোটেলে বা অন্য কোথাও কাজের জন্য যায়। যে বয়সে সবাই খেলাধুলো করে, পড়াশোনা করে সেই বয়সে সেই বাচ্চাটা নিয়ম করে সকাল বিকেল কাজ করে, তার কারণ হলো একটু টাকা উপার্জন করা। যে টাকা দিয়ে সে নিজের ও নিজের পরিবারের একটু হলেও অন্ন সংস্থান করতে পারবে। কিন্তু এতো টুকুতেও ক্ষান্ত না, সেই বাচ্চাটার কাজে একটু ভুল হলে তার ভাগ্যে থাকে মার, বকা, আর অন্য মানুষের থেকে পায় সহানুভূতি। যে সহানুভূতি তাকে আরো আগে সত্যিই পাওয়া উচিত ছিলো সেই সহানুভূতি সে তখন পায় আর সেটা তার জন্য অনেক অংশে ক্ষতিরও হয়। সেখান থেকেই অনেকে ‘শিশু শ্রমিক’ , ‘শিশু নির্যাতন’ বলে চিৎকার করেন, তারপর পুনরায় পুলিশ আসেন , দোকানের মালিককে পুলিশ বা আদালত একটা জরিমানার টাকা ধার্য্য করেন আর সেই বাচ্চাটাকে তার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পুনরায় বাচ্চাটা নিজের অন্ন সংস্থান করার ব্যবস্থা হারিয়ে ফেলে। দুদিন বাচ্চাটাকে সবাই মনে রেখে তিনদিনের দিন কেউ আর মনে রাখে না। যার জন্য এতো এতো আন্দোলন, পুলিশ ডাকা সব হয় সেই বাচ্চাটাই আর খেতে পারছে কী না সেটার খোঁজই আর কেউ রাখেন না। দোকানের মালিক তো তাও মায়া করে একটা কাজ দিয়েছিলো অন্যান্য মানুষরা সেটাও ছিনিয়ে নেয়। দিনশেষে বাচ্চাটার ভাগ্যে আর থাকে না দু মুঠো অন্ন। হায় রে মানুষ! যার জন্য এতোকিছু করলো সে খেতে পেলো কী না সেটাই দেখার সময় কারো নেই কিন্তু তার খাবার কেড়ে নেওয়ার সময় ঠিকই ছিলো। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে সেই বাচ্চাটাকে হোমে পাঠানো হয়, হয়তো সে খেতে পায় কিন্তু সবকিছুই একটা হয়তো তে সীমাবদ্ধ। খুব অদ্ভুত! তার মধ্যেও কোনো প্রতিভা থাকতে পারে সেটার খোঁজ কতোজন নেয় ? উত্তরটা না হয় সবাই বলুক। সেই প্রতিভার দ্বারা সেও কিছু করতে পারতো কিন্তু পারেনি তার কারণ তার ভাগ্য, কিন্তু কিছু এন.জি.ও বা অন্যরা যদি এই প্রতিভাদের খুঁজে বের করেন তাহলে সেই বাচ্চাই আগামীতে দেশকে উপস্থাপন করবে বিশ্বের দরবারে, ভারতের আরো একটি গর্বিত দিক সম্পর্কে জানতে পারবে সমগ্র বিশ্বের মানুষ।

আবার একটা বাচ্চা সিরিয়ালে অভিনয়ের সুযোগ পেলো, সে বেশ ভালো অভিনয় করে কয়েকদিনে অর্থ উপার্জন করলো, যদিও তার অর্থ উপার্জন করার প্রয়োজন ছিলো না। সেই বাচ্চা কোথাও একটা অভিনয়ে একটু দুঃখীর অভিনয় করলে সাধারণ মানুষ তার জন্য হাহুতাশ প্রকাশ করবে কিন্তু বাস্তবে যখন এমন কাউকে দেখে তখন আর তাদের মন থেকে মায়া জন্ম নেয় না। মানুষের মনও খুব অদ্ভুত, একজন বাস্তব জীবনের কারো জন্য মায়া থাকে না কিন্তু একজন অভিনয়ে একই জিনিস অভিনয় করলে তার জন্য মায়া থাকে ঠিকই। তখন সেই বাচ্চার অভিনয় দেখে চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল বিসর্জন দিয়ে তারা বলেন ‘শিশু শিল্পী’। বাহ্ সত্যিই মানুষ অসাধারণ! যার কাছে অর্থের ভান্ডার থাকে তার জন্যই থাকে সব মায়া মমতা, হোক না সেটা কোথাও অভিনয় করছে কিন্তু বাস্তবে এমন কাউকে দেখে তারাই নাক সিটকায়। আচ্ছা এটা কী শুধু আমাদের দেশের একটা রূপ না কী অন্য দেশেও এমন হয়ে থাকে? উত্তরটা খুঁজেও পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে সবাই সমান এই কথাটা শুধুমাত্র সিরিয়াল, সিনেমা, বই এই মনে হয় মানায় ভালো কারণ বাস্তবে এই কথাটা মানেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। একজন বাচ্চা অভিনয় জগতে ভালো অভিনয় করলে হয় ‘শিশু শিল্পী’ আর কোনো একজন বাচ্চা মিষ্টির দোকানে কাজ করলে হয় ‘শিশু শ্রমিক’ এটার হিসেব হয়তো আজ পর্যন্ত অনেক মানুষই মেলাতে পারেননি। শিশু শিল্পীদের মধ্যে যেমন প্রতিভা আছে ঠিক তেমনই শিশু শ্রমিকদের মধ্যেও প্রতিভা আছে, শুধু প্রয়োজন একটু খুঁজে বের করা তাহলে তারাও একদিন আমাদের দেশকে বিশ্বের দরবারে গর্বিত করবে পুনরায় এবং পুনরায়।

‘শিশু শ্রমিক’ দের কষ্ট বুঝে তাদের পড়াশোনার একটা সুযোগ দেওয়া হলে এবং তাদের প্রতিভা খুঁজে বের করা হলে তাদের এবং দেশের উভয়ের জন্যই গর্বের বিষয়। ‘শিশু শিল্পী’ যাদের বলা হয় একদিন হয় সেই ‘শিশু শ্রমিক’ দের প্রতিভা খুঁজে বের করার পর তারাও ‘শ্রমিক’ থেকে ‘শিল্পী’ হয়ে উঠবে। তাদের অনেক অনেক প্রতিভা খুঁজে পাওয়া যাবে এবং তাদের জন্য মানুষ নাক সিটকাবেন না বরং গর্ববোধ করবেন। বাহিরের দেশ থেকে যেমন আমাদের দেশের মানুষের আতিথেয়তার জন্য আসেন সবাই ঠিক তেমনই হয়তো নতুন নতুন প্রতিভাদেরও দেখতে আসবেন, আর সেই সাথে আমাদের আরো বেশি গর্ববোধ হবে। “ভারতীয়” হওয়ার জন্য আরো বেশি গর্বিত অনুভব করবে তখন।

You May Also Like