ধর্মাচরণ? নাকি হুজুগ মাত্র!

1 min read

শৌভিক রায়

হাসপাতালের দুশো মিটারের মধ্যে তারস্বরে ডিজে বাজছে। শোনা যাচ্ছে হংসরাজ রঘুবংশী সহ আরও অনেকের গান। দেবাদিদেব মহাদেবের উদ্দেশ্যে গাওয়া সে সব গানে যন্ত্রের এত বেশি ব্যবহার যে, গমগমে শব্দ বুকের মধ্যে ধাক্কা মারে। ওই আওয়াজের মধ্যেই ছোট ছোট প্যান্ডেলে দীর্ঘ লাইন পড়েছে শিবলিঙ্গে জল বা দুধ ঢালার জন্য। লাইনে সুবেশা তরুণী থেকে মাঝবয়সী প্রত্যেকেই রয়েছেন।

ধর্মীয় কোনও উৎসব যাপনের এই চিত্রটি এখন অতি সাধারণ। উত্তরের সব জনপদে, বড়-মেজো-ছোট অলিগলিতে, শিবরাত্রি সহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন আজকাল যথেষ্ট জোশ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। গত শ্রাবণ মাসে কোচবিহারের বানেশ্বরের ও জলপাইগুড়ির জল্পেশের রাস্তায় আগত পুণ্যার্থীদের জন্য একের পর এক জলসত্র দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। অবশ্য সেগুলিতে যে আওয়াজে ডিজে বাজছিল, তাতে এলাকাবাসীর জন্য কষ্টই হচ্ছিল।

এই ছবিগুলিকে খন্ড চিত্র মনে হলে ভুল করা হবে। আজকাল ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে উৎসাহ চোখে পড়ে, তা কিন্তু কয়েক দশক আগেও ছিল না। সব সম্প্রদায়ের মানুষই এখন নিজেদের ধর্মকে যেন তুলে ধরতে ব্যস্ত। আর তার জন্য যতটা দেখনদারি সম্ভব, ঠিক ততটাই করা হচ্ছে। এতে কারও অসুবিধে হোক বা ভাবাবেগে আঘাত লাগুক, কার কী এসে যায়!

কারও ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ধর্মাচারণ নিয়ে বলবার কিছু নেই। এই লেখার উদ্দেশ্য সেটিও নয়। প্রশ্ন হল, ধর্মাচারণের এই ব্যাপকতা আদৌ কি ধর্মকে ভালবেসে নাকি স্রেফ হুজুগে? চারদিকের কাণ্ডকারখানা দেখে কিন্তু একে হুজুগ ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। তা না হলে, এই উন্মাদনা কেন? ভক্তি ও শ্রদ্ধা কোথায়? সমর্পণই বা নেই কেন! এ তো স্রেফ ‘তোমার পুজোর ছলে’ আরাধ্যকে তো বটেই, নিজেকেও ভুলে থাকা!

সমস্যা হল, এই ‘ভুলে থাকা’ কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে নয়। সকলেই একই দোষে দুষ্ট। আজকাল সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে স্কুল কলেজ থেকে যে সংখ্যক ছাত্র উপাসনা করতে চলে যায় সেটা লক্ষ্য করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে এমনটি আগে দেখিনি। এই অভিজ্ঞতা সাম্প্রতিককালের। দুর্ভাগ্যের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিভিন্ন জনপদে ইদানিং ভোর থেকে শুরু করে দফায় দফায় প্রার্থনা শোনানোর যে ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সেটি মারাত্মক। এতে চুলোয় যাচ্ছে শব্দবিধি। সবাই দেখছি, শুনছি। কেউ কিছুই বলছি না। কেননা, কিছু বললেই গায়ে সেঁটে যাবে কিছু নির্দিষ্ট শব্দ।

এতেও হয়ত আপত্তি ছিল না। কিন্তু যখন দেখি ‘ধর্ম’ শব্দটির তাৎপর্য পাল্টে যাচ্ছে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগারে, ভয়টা তখন বাড়ে। এ কোনদিকে চলেছি আমরা? ‘ধর্ম’ মানে তো ধারণ করা। মানুষ ধারণ করে আছে মানবিকতা, নমনীয়তা। পৃথিবীর সব ধর্মই বলে এর চাইতে বড় আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু কোথায় তা?

ধর্মাচারণ হোক। কিন্তু সেটা যেন গণ হিস্টিরিয়ায় পরিণত না হয়। আসলে যে কোনও উন্মাদনাই আখেরে ক্ষতি আনে। এটা ভুলে গেলে ক্ষতি আমাদেরই! কেননা এই উন্মাদনা আমাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ধর্ম পালন করতে গিয়ে অধর্মের হাত ধরছি আমরা।

You May Also Like