স্বার্থপর

1 min read

পাহাড়ের বুক চিরে বেশ জোড়েই চলছে গাড়িটা – সন্ধ্যে নামার আগেই কার্শিয়াং ফিরতে হবে – শৈবালের পাশে বসা অনুর মনে হয় শীত শীত আমেজ ‘ আউটিংয়ের ‘ মজাটাকে বাড়িয়ে তুলছে অনেকখানি – ‘ ড্রাইভিং সিটে ‘ শৈবালকে বরাবরই চোখ বুঁজে ভরসা করে এসেছে অনু – যদিও এটা শুধু পাহাড়ের চড়াই উতরাইয়ের ক্ষেত্রেই নয় – জীবনের প্রতিটি ওঠা পড়ায় শৈবালের সাহচর্য যে অনুকে কতটা আশ্বস্ত করেছে ও স্বস্তি দিয়েছে তা শুধুমাত্র অনুই জানে। সোনালী এই বিকেলে তাল কাটে একটি টায়ারের বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে – দোকানপাট শূণ্য নির্জন একটা অঞ্চলে গাড়িটা স্থবির হয়ে যাওয়ায় টায়ার পাল্টানোর কাজে অন্য কারো সাহায্য যে কপালে জুটবে না তা বিলক্ষণ বুঝতে পারে শৈবাল – নিজেই লেগে পড়ে সেই কাজে – বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতে এখনও অনেকটা সময় বাকি তবুও শৈবাল একটা তাড়া অনুভব করে – শীতের বিকেল বলে কথা – দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে আসবে পাহাড়ের কোলে – দুপুরের পরেই সূর্য যেন তার পশ্চিমে নেমে যাওয়ার গতি বাড়িয়ে দেয় এই অঞ্চলে …!

অনুর কিছু করার নেই বলে পায়চারী করে – অলস পায়ে গাড়িটা থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে যায় অনু – বুঝতে পারে একটা গাড়ি যেন তাকে লক্ষ্য করেই বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে – চালক যে তড়িঘড়ি ব্রেক করেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না অনুর – ওদের গাড়িটা থেকে কত দূরে তা একবার দেখে নেয় – কিছুটা ভয় পেলেও বেশ বিরক্ত বোধ করে – মানুষ জনের স্বভাব বোধ হয় পাল্টানোর নয় – নির্জন পাহাড়ি রাস্তায়ও একা মহিলার নিস্তার নেই – সাহায্যের হাত বাড়ানোর আধিক্যেতা ( ! ) বোধ হয় কোনো কালেই কমবে না – কড়া ভাষায় প্রতিবাদের প্রস্তুতি পর্ব সেরে ফেলে অনু – নারীর অধিকার স্বাধীনতা ক্ষমতায়ণ নিয়ে লেখালেখি করা অনু আজ অন্তত একটা লোককে শিক্ষা দিয়ে তবে ছাড়বে – ততক্ষণে ‘ ড্রাইভিং সিটের ‘ পাশের জানালার কাঁচ নেমে গেছে অনেকটা – দমকা একটা হাওয়া অনুকে নিয়ে চলে যায় সায়েন্স কলেজের ক্যান্টিনে – হ্যাঁ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ , যেখানে সন্দীপ ও অনিমা নামের দুজন রোজ জমিয়ে আড্ডা দিত – মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকিও বাদ যেত না। কার্শিয়াং কলেজের কেমিস্ট্রির সিনিয়র লেকচারার ডঃ দত্ত এরকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা গত তিরিশ বছরে একবারের জন্যও ভাবতে পারেননি – সন্দীপ তো আমেরিকা চলে গেছিল , তবে কী …..?

অনুর সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল – শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে – আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না – অসহায়ের মত সেই দিন গুলোর কথা ভাবতে থাকে অনু – সন্দীপ তো অনুকে আমেরিকা নিয়ে যেতেই চেয়েছিল , কিন্তু ও তো নিজেই রাজি হয়নি। এরপরও সন্দীপের যোগাযোগ করার চেষ্টা গুলোকে এড়িয়ে গেছে বারবার – এত বছর বাদে পাহাড়ি রাস্তায় স্টিয়ারিং হাতে সন্দীপ অনুকে ঠিক ঠিক চিনে নিতে পারল কী করে ? – উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে অনু , কিন্তু ব্যর্থ হয় – তবে কী সন্দীপ এখনও অনুকে ভালবাসে ? – সন্দীপ কী এখনও একা ? – সব এলোমেলো হয়ে যায় – কোনো কিছুই যেন ভাবতে পারে না – ইতিহাসের অধ্যাপককে নিয়ে বেশ তো ছিল ! আজ একটা টায়ার তার জীবনটাকে ওলট-পালট করে দিল – ও কী নাসার চাকুরীটা ছেড়ে দিয়েছে ? – বুঝতে পারে না অনু। তবে এটা বুঝতে পারে যে যদি সন্দীপ তাই করে থাকে তবে বিজ্ঞান গবেষণা ও নিজের প্রতি চরম অন্যায় করে চলেছে সেদিনের ফিজিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছেলেটা – কত কিছু জানতে ইচ্ছে করে অনুর – কিন্তু কথা বলার সাহস পায় না …!

শৈবালের ডাকে যখন ঘুম ভাঙে তখন ঘেমে ভিজে গেছে অনু – হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারে না – নিজেকে এই প্রথম স্বার্থপর বলে মনে হয় – ততক্ষণে শৈবালের দৃষ্টি এড়িয়ে চোখের কোণের দুফোঁটা জল শুকিয়ে গেছে …..!

…………………….অনির্বান মজুমদার

You May Also Like