পার্থ নিয়োগী : শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালির নয় এপার বাংলার বাঙালির কাছেও মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল নিজেদের যুদ্ধ। তাঁর বড় প্রমাণ উত্তর প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে সেটাই আরেকবার প্রমাণ করল উত্তর প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার ৫০ বছর নিয়ে বাংলাদেশের ঠিক যে আবেগ আছে । সেই একই রকমের আবেগ আজও আছে পশ্চিমবাংলার বুকে। নইলে মুক্তিযুদ্ধ কে নিয়ে এত সুন্দর তথ্যবহুল এমন বিশেষ সংখ্যা করার কথা কেউ ভাবে ? এর আগেও শাহবাগ আন্দোলন কে নিয়ে অনুষ্ঠান ও একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল উত্তর প্রসঙ্গ। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের যে বিশেষ ভাবনা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এই বিশেষ সংখ্যায় আছে মোট ৪২ টি প্রবন্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে। সমাজের বিভিন্ন পেশার বিদগ্ধ লেখক,গবেষকদের লেখায় সমৃদ্ধ এই প্রবন্ধগুলি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সবার প্রথমে যে মানুষটির নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্থান। এই দুই রাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী একক প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে যে জনমত গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্ব ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আর ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও ইন্দিরা গান্ধী শীর্ষক প্রবন্ধে সেটাই অসাধারন লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিল কুমার সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ভাবে কুটনৈতিক বা সামরিক সাহায্য দিয়ে ভারত সরকার যেমন সাহায্য করেছে বাংলাদেশ কে। ঠিক তেমনি অনেক ভারতীয় সাধারন মানুষও নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে ৪৭ সালের তাদের ফেলে আসা জন্মভূমির মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন সাংসদ অমর রায় প্রধানের ভূমিকাও তুলে ধরেছেন পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্তিক চন্দ্র সূত্রধর । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম না বললেই নয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক ভবেশ দাশের কলমে উঠে এসেছে সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা। বাংলাদেশের মানুষের ওপর প্রতিদিন যুদ্ধের সময় যে অত্যাচার চালাত তার বিবরণ নিজের ভাষায় পাঠ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শোনাতেন সাংবাদিক আখতার মুকুল। যে অনুষ্ঠানটির নাম ছিল চরমপত্র। তা উঠে এসেছে বিশিষ্ট সাংবাদিক দেবদূত ঘোষ ঠাকুরের কলমে। বাংলাদেশের পটভূমিতে শেখ মুজিব ও তার প্রদর্শিত পথ নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন উত্তর প্রসঙ্গের সম্পাদক দেবব্রত চাকী। উদবাস্তু সমস্যা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এক বড় সমস্যা। ৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত তথ্যবহুল অনবদ্য এক লেখা প্রাক্তন আমলা ডঃ সুখবিলাস বর্মা তার ‘ মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। ‘ বিভক্ত রাজনীতি এবং দ্বিখন্ডিত জাতীয়তাবাদ ঃ স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর’ শীর্ষক রাজীব নন্দী ও অপরাজিতা দে এর প্রবন্ধটি অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক। প্রাক্তন সাংসদ তথা প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব দেবপ্রসাদ রায়ের কলমে মুজিব বর্ষে শেখ মুজিব কে নিয়ে অসাধারণ বিশ্লেষনমুখী লেখাটিও বেশ ভালো। শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে লিখেছেন চৈতালি ধরিত্রীকন্যা। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান নিয়ে প্রলয় নাগ যেমন লিখেছেন একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বৌদ্ধ নারীদের নিয়ে লিখেছেন রোমানা পাপড়ি। অবিভক্ত উত্তরবঙ্গের গবেষক তথা বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবি জাহাঙ্গীর আলম সরকারের কলমে ধরা পড়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বাংলাদেশ থিয়েটারের অতীত ও সাম্প্রতিক কথা সাবলীল লেখার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন নাট্যব্যাক্তিত্ব দীপায়ন ভট্টাচার্য্য। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক স্বাধীনতা পদকে ভূষিত আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কন্ঠযোদ্ধা অজিত রায়কে নিয়ে কলম ধরেছেন তারই কন্যা বর্তমান সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী শ্রেয়সী রায়। ইতিহাসবিদ ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষের লেখায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের হৃদয় বিদারক বৃতান্ত পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করবে। সঞ্জয় সাহা্ ,গোপা পাল ঘোষ চৌধুরী হরিপদ রায়ের প্রবন্ধের মধ্যেও আছে অজানা অনেক মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এপার বাংলার বিভিন্ন জেলা ও জনপদের মানুষের ভূমিকা এই গ্রন্থে তুলে ধরাটা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আজ হয়ত অনেকেই ভুলে যাচ্ছে বা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল হিন্দু ও মুসলিম বাঙালির সন্মিলিত লড়াই। সেটাই আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন নিজের লেখায় বীর মুক্তিযোদ্ধা বিনয় দাস। মুক্তিযুদ্ধে সামনে থেকে পাকিস্থানের খান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে প্রচুর ভারতীয় সেনা ও বিএসএফ জওয়ান। তাদের কথা হয়ত আজ আমরা ভুলেই গেছি। এমনই একজন বিএসএফ জওয়ান হলেন নিকুঞ্জ দাস। আর তার সাক্ষাৎকার যৌথ ভাবে নিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরার যে প্রয়াস নিয়েছেন উত্তর প্রসঙ্গের সম্পাদক দেবব্রত চাকী ও মনোজিৎ দাস তা এককথায় অনবদ্য। গণেশ মহন্ত এক মুক্তিযোদ্ধা। রাজবংশী সম্প্রদায়ের এই মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি ছিল গাইবান্ধা জেলার হামিন্দপুর গ্রামে। বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছিলেন তিনি সেই দেশ থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়ে বর্তমানে থাকেন কোচবিহারের বড় শোলমারী গ্রামে। ‘ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক প্রবন্ধে গণেশ মহন্তের করুন কাহিনী তুলে ধরেছেন শঙ্খনাদ আচার্য। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক চিত্র বইটিকে করেছে সমৃদ্ধ। ভালো লাগে বইটির প্রচ্ছদ ভাবনা। একটা বইতে হয়ত সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরা যায়না কথাটা যেমন সত্যি। ঠিক ততোটাই সত্যিই অনেক নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, শ্রম এবং ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে এমন সংখ্যা প্রকাশ করা অসম্ভব। আর ঠিক সেখানেই উত্তর প্রসঙ্গের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর নিয়ে বিশেষ সংখ্যার স্বার্থকতা।
সারা জীবন রেখে দেবার মত উত্তর প্রসঙ্গের ‘ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর’ বিশেষ সংখ্যা
- By editor
- May 1, 2023
0 min read
You May Also Like
স্মৃতির হিমালয় যখন বই হয়ে ধরা দেয়
July 28, 2023
ধর্মাচরণ? নাকি হুজুগ মাত্র!
July 16, 2023
অনলাইন ম্যাগাজিন নেট ফড়িং
July 16, 2023