বর্ণমালার ঘ্রাণ

1 min read

সকাল এগারোটা। শেয়ালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির দরজায় জং-ধরা ধুমসো প্রাগৈতিহাসিক তালাটা এখনও গভীর ঘুমে কেতরে পড়ে আছে। যদিও এই ছবিটা এখন সকালে সূর্য ওঠা আর সন্ধেয় অস্ত যাওয়ার মতই স্বাভাবিক। কেউ ফিরেও তাকায় না এসব ছিঁচকে অসংগতির দিকে। মানুষজন এখন ভীষণ ব্যস্ত ও নৈর্ব্যক্তিক। শেয়ালকাটায় যে একদা লাইব্রেরি বলে ছোট্ট একটি ঘর ছিল যেখানে রোজ মানুষজন আসতেন বই পড়তে, বাড়িতে বই নিয়ে যেতেন, সারাদিন খোলা থাকত ঘরের দরজাটা, আশপাশের চা-বাগানের পিওন কিংবা ডাকওয়ালারা বাবুদের বইয়ের লিস্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, গ্রন্থাগারিক সেসব সামলাতে হিমসিম খেতেন, এসব জীবিত পূর্বজদের জানা থাকলেও নব্য মানুষজন এসব কিছুই জানেন না।

লাইব্রেরির বাইরের চাতালটায় ‘হ্রস্ব-উ’-এর মতো উটকো হয়ে বসে রাখু এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে খচে গিয়ে রাগে ফুলছিল হাপরের মতো। ফাতনাপুর চা-বাগানের মালবাবু রাখালচন্দ্র সামন্ত ওরফে রাখু উটকো হয়ে বেশীক্ষণ বসে থাকতে পারেনা । পাইলসের সমস্যা আছে। কষ্ট হয়। আর সেই কষ্টটাই খচে ওঠার বিক্রিয়ায়  অণুঘটকের কাজ করছিল। রাখু তাই কোমর আর নিতম্ব প্রদেশকে একটু রিল্যাক্স দিতে খেপে খেপে উঠে চট্ করে পায়চারিটা সেরে নিচ্ছিল বিজ্ঞাপন বিরতির মতো। একসময় পঞ্চম বিড়িটার পোঁদে ‘ফুঁক’ করে তেড়ে একটা ফুঁ মেরে অন্তর্ঘাতী ধুলোর সাথে জগার ওপর তীব্র রাগটাও বাতাসে ছুঁড়ে দিল রাখু। দাঁত কিড়মিড় করতে গিয়ে যদিও সেটা যুতসই হলো না। মোলার, প্রিমোলার গুলো যৌবনেই পাইরিয়ার রোড-রোলারের চাপে শহীদ হয়ে গেছে। এখন গুটিকয় কৃন্তক আর শ্বদন্ত হাঁ করলেই ঝলসে ওঠে ড্রাকুলার মতো।

লাইব্রেরিয়ান জগবন্ধু দাসের এখনও পাত্তা নেই। কদিন ধরে লাগাতার ফোন করার পর গতরাতে ফোন তুলেছিল। বলেছিল দশটার মধ্যে ঢুকে যাবে।  ব্রেকফাস্ট-ব্রেক এ বড়- সাহেবকে ‘ওষুধ কিনতে যাচ্ছি’ বলে আধঘন্টার ছুটি নিয়েছিল রাখু। দেরি হলে কেস খেতে হবে। বইগুলো জমা দিয়ে আরো একমাসের খোরাক নেবে বলে বাজারের ব্যাগের সাথে একস্ট্রা ব্যাগও নিয়ে এসেছিল সে। জীবনে বই আর বিড়ি ছাড়া আর কোনও নেশা নেই রাখুর। সারাদিন অফিস করে গভীর রাত পর্যন্ত বই পড়ে। বই পড়তে পড়তে মেঝেময় বিড়ির ছাইয়ে আলপনা দেয়। বৌ অনেক আগেই এসব উৎপাতের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে আলাদা ঘরে শোয়। এখন ছেলে মেয়েরাও বাবাকে সংসারে এক বিচিত্র জীব বলে মনে করে। লাইব্রেরীর অর্ধেক বই-ই গিলে খেয়েছে রাখু। একদিন বই না হাতে পেলে তাই মেজাজ খিচড়ে থাকে। আপাতত জগার ওপর ক্ষেপে আছে রাখুর মেজাজটা।

প্রথম প্রথম জগা অবশ্য রোজই আসত। এসে দরজা,জানলা খুলে, নিজে হাতে ষোল বাই কুড়ির ঘরটার ধূলো ঝেড়ে জলছড়া দিত চৌকাঠে। তারপর ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রবিঠাকুর, বিদ্যাসাগর, দেশবন্ধু হয়ে রাধাকৃষ্ণন সকলকে সুগন্ধি ধোঁয়ায় আমোদিত করে টেবিলটা ঝেড়ে পুঁছে মেম্বার রেজিস্টারটা খুলে একবার চোখ  বুলিয়ে জানালা দিয়ে হাঁক পাড়ত রাস্তার উল্টো ফুটের চায়ের দোকানের ছোকরাটিকে। চায়ের সাথে সিগারেট ধরিয়ে তাক থেকে টেনে নিত নিজের পছন্দ মতো কোনও বই সময় কাটাতে। রাখু এলে তাও গল্পে কথায় কিছুটা সময় কাটত। কিন্তু রাখুর হাতে যে সময় বড় কম। বই নিয়েই সে ছুট দিত বাড়ির পথে।

সপ্তাহ খানেক পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার বাইকের তেল পুড়িয়ে আসা যাওয়া করে শেয়ালকাটার হাওয়াটা বুঝে  জগবন্ধু ছকে নিয়েছিল পরবর্তী কর্মসূচি। লোকাল পঞ্চায়েত মেম্বারকে ফিট করে সামনের পানের দোকানের মালিককে পটিয়ে লাইব্রেরির চাবিটা গচ্ছিত রেখে  মাসে দু’ একদিন করে বুড়ি ছোঁয়া দিতে লাগল। চাকরিটাও থাকল, আর এই একঘেয়ে জীবনটাও কাটাতে হল না।

কিন্তু বিধি বাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই রাখু। কদিন না এলেই ফোনের পর ফোন। মনে মনে বিরক্ত হতো জগা, ” আরে এত পড়ে কোন পণ্ডিত হবি রে তুই! এ যুগে কেউ এত বই পড়ে নাকি! নেট খুললেই তো সব জানা যায়”। কিন্তু সরকারি গ্রন্থাগারিক হয়ে এসব বলা যায় না। তাছাড়া রাখালচন্দ্র লোকটা ট্যারা টাইপের। মাঝে সাঝেই হুমকি দেয়,না এলে ওপর তলায় নালিশ করবে।

বিরক্তির চরম সীমায় উঠে জগার ফোনে ফোন করে রাখু। ফোন সুইচড- অফ শোনায়। গজগজ করতে করতে পান দোকানের কাছে এসে দোকানিকে চাবির কথা জিজ্ঞেস করে রাখু জানতে পায় চাবি জগবন্ধু নিয়ে গেছে। রাগে দোকানিকে উদ্দেশ্যে করে জগবন্ধু সম্পর্কে যা মুখে আসে তাই বলে যেতে থাকে রাখু। পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে মনোযোগী ছেলেটি এতক্ষণ সব শুনছিল।  রাখু শান্ত হতেই সে বলে, ” কাকু, তুমি বই পড়তে খুব ভালবাস তাই না। কষ্ট করে এতদূর এসে বই নিয়ে যাওয়ার কী দরকার। অ্যাপস ডাউনলোড করে নিলেই তো পার। হাজার হাজার বই পড়তে পারবে ঘরে বসে। ”

রাখু কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। তারপর নিচু হয়ে একটা বই বের করে বাজারের ব্যাগ থেকে। বইটা খুলে ছেলেটার নাকে সামনে সটান মেলে ধরে বলে, ” শোঁকো।”

-” মানে! ” ছেলেটা অবাক হয়ে তাকায়। হয়তো বা বিরক্তও।
-” শোঁকো..কিছু বুঝলা? বোঝো নাই তো? বুঝবাও না। বোঝার দরকারও নাই। ”

বইটা ব্যাগে পুরে সাইকেলে উঠে পড়ে রাখু। সাইকেল চালাতে চালতে বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকা গন্ধটা শেষ মুহূর্তে টেনে নেয় নাকে। কাগজের গায়ে লেগে থাকা কালো বর্ণমালার চনমনে, চমৎকার জীবনদায়ী ঘ্রাণ।

You May Also Like