সেরা বন্ধু

1 min read

চিত্তুরাখন্ডের গাড়োয়াল প্রদেশের এক পান্ডব বর্জিত পাহাড়ীতলীর মেয়ে আমি। এখানে শিক্ষা আলো এখনো অতটা দীপ্তমান নয়।
আমাদের জনজাতির অবুঝ, নাবালিকা মেয়েদের তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে অলিখিত বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটাকে আমি আমাদের সমাজের এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ বলে মানি। এখানে আইনও কিছু করতে পারবে না। সব কিছুই হয় লুকিয়ে-চুপিয়ে। পূর্বতন কিছু ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছোট ছোট মেয়েরাও এটা মেনে নিতে বাধ্য হয়, মানিয়েও নেয়। তবে বর্তমানে লুকিয়ে বিয়ে হয়ে গেলেও মেয়েরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, এটা একটা বড় সুখবর।
মাঝে কয়েকটা এন.জি.ও. আইনের সাহায্য নিয়ে এই দৌরত্ব্য কিছুটা কমিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধর্মীয় গোঁড়ামীকে উস্কানী দিয়ে আবার তা অতীতের কালো দিনে পর্যবসিত করেছে।
আমার জীবনের ইতিহাসের কাহিনীটা খানিকটা ওরকমই। বেশ করুণ। বাবা চাকুরিজীবি, উচ্চ-শিক্ষিত হলেও পুরোন সামাজিক রীতিনীতির ফাঁদে পড়ে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তখন আমার সংসার, সহবাস করবার বয়স হয়নি। এক বছর আমি দিনরাত নিদারুণ অমানুষিক অসহ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেছি। পরে বাবা তার নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে শ্বশুরবাড়ী থেকে বাড়ীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ততদিনে আমার এক বছর পড়াশুনোর ক্ষতি হয়ে গেছে। রাতে ঘুমের মধ্যে ‘জেনোফোবিয়া’তে বারবার চিৎকার করে উঠতাম। তবুও আমি হারিনি, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছি।
নিয়মের বেড়াজালে যখন বাবার দ্বিতীয়বার সাঁতরাগাছিতে রুটিন ট্রান্সফার হয়েছিল, তখন সবেমাত্র কিছুটা ধাতস্থ হয়েছি। শুধু সময় মতো স্কুলে যেতাম। বাকী সময়টা সারাদিন পড়াশোনায় ব্যাস্ত থাকতাম অথবা আনমনা হয়ে জানালার পাশে বসে বসে দিন কাটিয়ে দিতাম। কোনো অচেনা পুরুষ মানুষ বাড়ীতে দেখলেই ভয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে খিল দিতাম। ভয়ে কোথাও টিউশনিও পড়তে যেতে পারতাম না।
এ সময়ই আমার জীবনে হঠাৎ করে বাবার সহকর্মী মনোময়কাকুর ছেলে অঙ্কনদাদার উদয় হয়। আচার-ব্যবহারে যথেষ্ট নম্র, ভদ্র, অমায়িক। তবে একটু মাতাল। আমাকে বাড়ীতে টিউশনি পড়াতে আসত। মূলত অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াত। তবুও যেহেতু বাকী বিষয়গুলিতে সেই মূহুর্তে আমার কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না, তাই যতটা পারত বাকী বিষয়গুলিও একটু একটু দেখিয়ে দিত।
বিকেলে রেইমন্ড ঝিলের পাশে বেড়াতে যাওয়া, পার্কে যাওয়া, সিনেমা দেখা, মেলাতে ঘোরাফেরা করা, দাদার সহচর্যে ধীরে ধীরে আমি জীবনের মূলস্রোতে ফিরে আসতে পেরে ছিলাম।
আমার জীবনটা যে আবার হাসি-খুশিতে ভরে উঠেছিল। তা বাবা-ছোটকাকার নজর এড়ায়নি। তাই বাবা-কাকা আর দেরী করেননি, আঠারো পেরোতেই দুই পরিবারের সহমতিতে দু’জনের পাকাপাকি ভাবে রেজিস্ট্রী করিয়ে চার হাত এক করে দিয়েছিলেন।
দাদাকে হয়তো স্বামী হিসেবে অতটা মানি না, যতটা ভালো বন্ধু ভাবি। তবে একটা কথা মানি, আমার প্রথম স্বামীর চেয়ে দাদা শত গুণে অনেক ভালো। কখনো আমার উপর জোর খাটায় না। বরং আমি যাই কাজ করি না কেন? তাতে প্রচন্ড উৎসাহ যোগায়। এই যে লকডাউনের পর থেকে এখন একটু-আদরু লেখালেখি করি, এতে আমার চেয়ে ওরই আগ্রহ তুঙ্গে থাকে। যেন ও নিজে লিখছে। বড় বড় লেখাগুলো কম্পোজ করে দিয়ে যথেষ্ট হেল্প করে ও।
আমিও ওকে বাধা দেই না, নেশা করে যদি পুরোন প্রেমিকাকে ভুলে থাকতে পারে, থাকুক। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
আসলে, দু’জনেই তো ডুবন্ত নৌকার সওয়ারী ছিলাম। এখানে কার দোষ? কি করে ওসব হল? এখন ওসব ভাববার সময় নেই। মানিয়ে চললেই হল। সত্যি, এমন একটা বন্ধুকে কাছে পেয়ে, এখন আমি খুব সুখী।

You May Also Like