সঙ্গীত পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে সঙ্গীত। সময়ের সঙ্গে ব্যস্ত জীবনে অবসাদে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দৈনন্দিন জীবনের ক্রমবর্ধমান ক্লান্তি এবং ইঁদুরদৌড়ে মনকে শান্ত রাখতে এবং নতুন করে জীবনকে উপভোগ করতে, এখন অনেকেই সঙ্গীতের সাহায্য নিচ্ছেন। সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘মিউজিক থেরাপি’।
‘মিউজিক থেরাপি’ কী
‘মিউজিক থেরাপি’-তে একজন মনোবিদ ক্লায়েন্টের থেরাপির জন্য সঙ্গীতের সাহায্য নিয়ে থাকেন। কখনও সেখানে বাদ্যযন্ত্র বা তালবাদ্যের সাহায্যও নেওয়া হতে পারে। সঙ্গীতের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র সুপ্রাচীন হলেও ‘ক্লিনিক্যাল থেরাপি’ আকারে তার ব্যবহার অপেক্ষাকৃত নবীন প্রয়াস।
কাদের প্রয়োজন
মিউজিক থেরাপিস্ট চন্দ্রিমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যে কেউ এই ধরনের থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন। পেশায় ১২ বছরের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই তিনি বলেন, ‘‘ভালো কথা বা ভাষণ যাকে ‘শব্দ-স্নান’ বলা যেতে পারে, তা আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। একইভাবে সঙ্গীতও আমাদের মনের বন্ধ দরজাগুলো খুলে দিতে পারে। তখন মনের জমা না বলা কথাগুলো বাইরে চলে আসে।’’
তবে জটিল রোগ থেকে সুস্থ হচ্ছেন, ডিমেনশিয়া, অনিদ্রা বা অ্যালঝেইমার্স রোগীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের থেরাপি উপকারী। আবার বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এই থেরাপি কার্যকরী। বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের নিয়েই মূলত কাজ করেন মিউজিক থেরাপিস্ট কাকলি চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘ওদের মধ্যে কেউ হয়তো কথা বলে না। কেউ মনের কথা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না। সঙ্গীত সেখানে খুব সাহায্য করে।’’
গান তো সকলেই শোনেন
কমবেশি প্রত্যেকেই গান শুনতে ভালোবাসেন। তবুও আলাদা করে ‘থেরাপি’ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জানা যাচ্ছে, নিজে গান শুনলেও মন ভালো হয়। কিন্তু সেখানে কথা বলার বা মনের পরিস্থিতি অনুযায়ী সঙ্গীত বেছে দেওয়ার মানুষটি উপস্থিত থাকেন না। আর একজন মিউজিক থেরাপিস্ট সেই কাজটাই করেন। এ প্রসঙ্গে কাকলি বলেন, ‘‘ভৈরবী রাগ উচ্চ রক্তচাপ এবং উদ্বেগের ক্ষেত্রে খুব উপকারী। আবার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলে, সেক্ষেত্রে শিবরঞ্জনী রাগ খুবই কার্যকরী।’’ সঙ্গীত ও সুরের মধ্যে মন ও স্মৃতির পুর্নগঠনের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। চন্দ্রিমার কথায়, ‘‘সঙ্গীত শক্তিশালী। তবে সমস্যা অনুযায়ী তাকে ব্যবহার করা হয়। কত রোগীকে দেখেছি, সঠিক সঙ্গীতের ব্যবহারে নতুনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। কেউ বা হারানো ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছেন।’’
কী ভাবে করা হয়
এই থেরাপিতে ব্যক্তিকে সাধারণত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত (যেমন মল্লার, ভৈরবী ইত্যাদি) শোনানো হয়। কখনও বিভিন্ন শ্লোকও ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি, চলতে থাকে থেরাপিস্টের সঙ্গে কথোপকথন। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যক্তিকে কোনও গানও শোনানো হতে পারে। সেই গানের তালিকায় জনপ্রিয় হিন্দি বা বাংলা গানও (যার মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রসঙ্গীত) থাকতে পারে। কেউ কেউ নিজে গান গেয়েও শোনান। শৈশবে শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন চন্দ্রিমা। তিনি বললেন, ‘‘বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে থেরাপি করেন। আমি যেমন নিজেই গান গেয়ে শোনাই।’’ সবশেষে মনোবিদ তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী ক্লায়েন্টকে পরবর্তী পদক্ষেপ বা সেশন সম্পর্কে অবহিত করেন।
বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে কোনও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে থেরাপি শুরু হয়। সেখানে ধ্যানও থাকতে পারে। যাঁরা কথা বলতে পারেন, তাঁদের সঙ্গীতের বিভিন্ন সরগম অভ্যাসের পাশাপাশি রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত শোনানো হয়। আবার শ্রবণশক্তি এবং প্রতিক্রিয়ার উন্নতিতে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েও শোনানো হয়। কাকলি বললেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশেষভাবে সক্ষম শিশুরা সঙ্গীত শুনতে বা কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পছন্দ করে। তাদের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের ইতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য।’’
ক’টা সেশন
‘মিউজিক থেরাপি’র প্রতিটি সেশন এক থেকে দেড় ঘণ্টার হতে পারে। ব্যক্তিগত ভাবে বা ছোট ছোট দলেও থেরাপি করানো হয়। ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতির উপরে ‘মিউজিক থেরাপি’র সেশনের সংখ্যা নির্ভর করে। কারও কারও ক্ষেত্রে দুই থেকে চারটি সেশনে উপকার পাওয়া যায়। আবার এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা অন্য কোনও থেরাপির মতোই (যেমন ফিজিওথেরাপি) নির্দিষ্ট সময়ান্তরে ‘মিউজিক থেরাপি’ নিয়ে থাকেন। যদি কেউ থেরাপি নিয়ে ভালো থাকেন, তাহলে সেশনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
কোথায় কোথায় হয়
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘মিউজিক থেরাপি’র চাহিদা বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সেন্টার রয়েছে। একাধিক বড় হাসপাতালেও আলাদা করে রোগীদের জন্য ‘মিউজিক থেরাপি’র ব্যবস্থা করা হয়। কেউ কেউ বাড়িতে আলাদা করে সেশনের পরিষেবাও দিয়ে থাকেন।
খরচ কেমন
সাধারণত দলগত থেরাপির চেয়ে একক স্বাধীন থেরাপির খরচ বেশি হয়। জানা যাচ্ছে, ‘মিউজিক থেরাপি’র সেশন প্রতি খরচ ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কীরকম
শহরে এখন মিউজিক থেরাপির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কোনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড না থাকায় এক এক জন এক এক ভাবে থেরাপি করে থাকেন। আগামীদিনে জীবনের ব্যস্ততা এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ সমাজে শান্তির খোঁজে এইধরনের থেরাপির গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে বলেই আশা করা হচ্ছে।
