ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা: ভারতীয় নৃত্যের রূপান্তর

শুভজিৎ চক্রবর্তী, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, দিনহাটা

নৃত্য-গীত-বাদ্যের সম্নন্বয়ে যে সঙ্গীতের কথা ভরত মুনি তার নাট্য শাস্ত্রে লিখে গিয়েছিলেন, সেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে আজ মিশেছে পশ্চিমা সংস্কৃতি। ভারতীয় নৃত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের আটটি প্রধান ধরণ রয়েছে- ভরত নাট্যম, কত্থক, ওড়িশি, কথাকলি, মণিপুরী, কুচিপুড়ি, মোহিনীয়াট্টম, সাত্রিয়া নৃত্য। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রচেষ্টায় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও প্রচারে এই নৃত্যের জনপ্রীয়তা বজায় থাকলেও, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখার আগ্রহ কমছে কারণ, এই শিল্প আত্মস্থ করতে যথেষ্ট সময় এবং কঠোর শৃঙ্খলা প্রয়োজন। অন্যদিকে, আধুনিকীকরণ ও পশ্চিমা সংস্কৃতির সংমিশ্রণে শুধুমাত্র ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যই নয়, লোকনৃত্যও তার মৌলিকতা হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিছুদিন আগেই এক জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো-তে ভরত নাট্যমের পোশাক পরে বলিউড গানে নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায় দুই তরুণ শিল্পীকে। তা নিয়ে সমাজ মাধ্যমে যথেষ্ট বার্তালাপ হয়। প্রথিতযশা শিল্পীরাও এর প্রতিবাদ করেন। তবে, এই আলাপ-আলোচনা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে কতটা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে তা বোঝা দুষ্কর। তবে, বিশ্বমঞ্চে ভরতনাটম্যের মতো জনপ্রিয় শৈলীর পরিবেশন অন্যদিকে, কুচিপুড়ির মতো নৃত্যের ঘরানা থেকে না বের হওয়ার মতো দৃষ্টান্ত, ভারতীয় শিল্পের সহজতা ও কঠোরতা উভয়কেই প্রকাশ করে। একটু ইতিহাস ঘেটে দেখলে বোঝা যাবে ভারতীয় নাচ চিরকালই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এখানে ভরত নাট্যমের কথাই তুলে ধরা যাক।   

আমাদের এখনকার জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত ভরত নাট্টমের পূর্বসূরি ছিল সাদির নাট্টম। এটি দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জর অঞ্চলে প্রথম সৃষ্টি হয়। যা ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ ভারতের নৃত্য শৈলী। এটি প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলিতে দেবদাসীদের দ্বারা পরিবেশিত হত। যা আমরা সঙ্গম সাহিত্যেও এর উল্লেখ পাই। রাজশাসনকালে এই নৃ্ত্য শৈলী যতটা রাজাদের কাছে জনপ্রিয় ছিল, ব্রিটিশ শাসনকালের সময় তার পুরোপুরি অবনতি ঘটে। এবং, দেবদাসীরা এটিকে আরও স্পষ্ট যৌনতা পূর্ণ নৃত্যে রূপান্তরিত করে। পরবর্তিতে যার সামাজিক অবনতি ঘটে ও সামাজিক স্বীকৃতি অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই নৃত্যশৈলীর আবার পুনরজ্জীবন ঘটে এবং এটিকে ভরত নাট্যম নৃত্যশৈলী নামে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়।

প্রথম অবস্থায় এই নৃত্যটি মন্দিরগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হত। এবং রাজা ও রাজপরিবারও এর পৃষ্ঠপোষক ছিল। সঙ্গম সাহিত্যেও এই নাচের উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং চোল রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত বিভিন্ন মন্দিরেও নৃত্যভঙ্গি সম্পর্কিত ভাষ্কর্য দেখা যায়। যা তাঞ্জোর শিল্পকলা হিসেবে জনপ্রিয়। ব্রিটিশ শাসন কালের পরবর্তী পর্যায়ে এই দেবদাসী প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে। এবং এর ওপর সামাজিক কলঙ্ক যুক্ত হয়। এর ফলে এই সাদির নাট্যম নৃত্যশৈলীটি তার ঐতিহ্যবাহী রূপ থেকে সরে আসে।

বিংশ শতাব্দীতে রূদ্রাম্মাদেবী আরূণ্ডেল, তার বোন রুক্মিণী দেবী এবং তাঞ্জাবুর কোয়ার্টেট-এর (ঘরানা)  মতো শিল্পীরা এই নৃত্যকলাটিকে নতুন রূপ দেন। এবং মন্দির শৈলী থেকে বেরিয়ে এসে এই নৃত্যকলাটি নতুন জীবন পেয়ে সাদির নাট্যম থেকে ভরত নাট্যমে রূপান্তরিত হয়।

আবার অনেকে মনে করেন, ভরত নামক মুনি এই ভরত নামক নৃত্যশৈলীর নাম নির্দেশক। অনেক গবেষকের বক্তব্য, ভরত নাট্যমের ভরত শব্দটি ভারত কথা থেকে এসেছে, এবং নাট্যম শব্দটি এসেছে নৃত্য অভিনয় থেকে। আধুনিক কিছু গবেষক ও নৃত্যকলাকারেরা মনে করেন যে, এই ভরত নাট্যম ভাব, রাগ, এবং তাল এই তিনটিকে সমানভাবে প্রকাশিত করে। তাই ভাবের ভ, রাগের র, এবং তালের ত- এই তিনটি শব্দের আদ্য অক্ষর থেকে এই নৃত্যশৈলীর নামকরণ। যা আজ মন্দির শৈলী থেকে বেরিয়ে এসে একটি বহুল প্রচলিত এবং পৃথিবী বিখ্যাত নৃত্যশৈলীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন এটি শুধু মন্দির কেন্দ্রিক নয়, দর্শকদের মনোজ্ঞ এবং সাংস্কৃতিক জগতের কাছে এক যুগান্তকারী শিল্পকলা।

রাজ আমলে যখন নৃত্যটি শুধুমাত্র মন্দির কেন্দ্রিক বা দেবদাসী কেন্দ্রিক ছিল, তখন কেবল দেবদাসী অর্থাৎ মহিলাদের দ্বারাই এটি পরিবেশিত হত। পরবর্তীতে মহিলাদের ওপর যখন বাইরে খোলামেলা ভাবে মেশার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তখন পুরুষরা স্ত্রী বেশ ধারণ করে এই নৃত্য কলা জনসমক্ষে নিয়ে আসে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রুক্মিণী দেবী, আরুণ্ডেল সহ অন্যান্য নৃত্য প্রশিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় শহরাঞ্চলের মহিলারাও এই নৃত্য প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে, তখন এই শিল্পকলা পুরুষ নারী নির্বিশেষে সমাজের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সমৃদ্ধি পায়।

অর্থাৎ, ভারতীয় নৃত্যকলা চিরকালই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। বিশের শতকের মাঝামাঝি থেকে ভারতীয় নৃত্যকলা বিশ্বের মঞ্চে প্রতিষ্ঠা পায়। এমনকি ভারতের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পীরা পাশ্চাত্য শিল্পের সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যের মিলন ঘটিয়েছেন। তারপর, ১৯৫০ সাল থেকে বলিউডেও ধ্রুপদী, লোকনৃত্যের পাশাপাশি পাশ্চাত্য শৈলী জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তারপর থেকে ফ্ল্যামেঙ্কো, আফ্রিকান শৈলী, জ্যাজ, হিপহপের মতো একাধিক নৃত্যশৈলী ভারতে বিখ্যাত হয়ে পড়ে। অনেকেই মনে করেন যে, ভারতীয় নৃত্যকলা ভবিষ্যতে আরও প্রযুক্তি নির্ভর হবে। রিয়েলিটি শোগুলিতে ইতিমধ্যেই মোশন পিকচার, ডিজিটাল প্রজেকশনের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার নৃত্য পরিবেশনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মনে করা হয় এই প্রযুক্তির ব্যবহার ভারতীয় নৃত্যকে বিশ্বের দরবারে আরও জনপ্রিয় করে তুলবে। কিন্তু, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও আধুনিকীকরণের মধ্যে ভারসাম্য না রাখতে পারলে যে বড় বিপদ একথাও অস্বীকার করা যায় না। আধুনিকীকরণ ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে যেন লোকনৃত্য বা ধ্রুপদী নৃত্য তার মৌলিকতা না হারায় তাও লক্ষ রাখা প্রত্যেক নৃত্য শিল্পীদের দায়িত্ব। কন্টেম্পোরারি নৃত্যশৈলী যে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় হবে তা স্বাভাবিক। কারণ, এর সহজতা শিল্পীদের নিজস্ব অভিব্যক্তি ও সৃজনশীলতা প্রকাশে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। ধ্রুপদী বা শাস্ত্রীয় নৃত্যের তুলনায় এর কম কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলা একে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। আর ভারতীয় নৃত্যের সঙ্গে প্রাশ্চাত্য শৈলীর মিশ্রণ একে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। তবে, কন্টেম্পোরারি ও বলিউড নৃত্যের প্রভাবে যে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের মূল রূপ ও কাঠামো নষ্ট হচ্ছে না, তা বলাও বাহুল্য নয়। এছাড়াও, শাস্ত্রীয় নৃত্যের জন্য যে অর্থনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন সেটাও এখন সীমিত। নতুন প্রজন্মের নৃত্যশিল্পীদের এই বিষয়টিও ভাবাচ্ছে। তাই, প্রয়োজন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা। এছাড়াও, স্পনসরশিপ, সাংস্কৃতিক সহযোগীতা দরকার যা নতুন প্রজন্মে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। এভাবেই ভারতীয় নৃত্যের ঐতিহ্য ও মৌলিকতা রক্ষার্থে শিল্পী সহ সকল শ্রেণির পৃষ্ঠপোষককে এগিয়ে আসতে হবে। তাতেই ভারতীয় নৃত্যশিল্প তার প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখে আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করে এক অনন্য শৈলি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে আরও ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে।