কর্মক্ষেত্রে নারী

শ্রীতমা ভট্টাচার্য্য

একটা সামান্য প্রশ্ন রাতের বেলা মেয়েদের বাইরে বের হওয়া ঠিক কতটা নিরাপদ? ঠিক কত রাত? সময়টা নির্দিষ্ট করে বললে সুবিধে হয় সবারই। অঞ্চল ভেদে এই সময় পরিবর্তন হয়। কারও বাড়িতে রাত ন’টা বা কারও বাড়িতে সন্ধ্যা ছ’টা। বান্ধবীদের মুখে একটাই কথা ‘আমাকে তো ন’টার মধ্যে ফিরতেই হবে।’ তবে সবার পক্ষে কি আদৌ সম্ভব এই বিধিনিষেধ মানা? তা মানলে কি আজ মঙ্গলযান, চন্দ্রযানের সাফল্যে কোনও মহিলার কথা খবরের কাগজে উঠে আসত? উত্তরটা হয়তো কারও জানা নেই ঠিক কটার মধ্যে, কোথায় ফিরলে ওরা নিরাপদ।

প্রসঙ্গ যখন নারীশিক্ষা, বা নারী স্বাধীনতা, তখন অসংখ্য কাগজে অসংখ্য লেখা। ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এই বিষয়গুলো এখনও প্রাসঙ্গিক এবং এগুলো নিয়ে লেখালেখির প্রয়োজন পড়ে। সেখানে বর্তমান যুগে ভারতে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান নাকি পিতৃতান্ত্রিক ধারনাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। নারী বিজ্ঞানীদের সাফল্য যেখানে দীর্ঘদিনের লিঙ্গ-কেন্দ্রিক পক্ষপাত ভেঙে দিচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে রিসার্চ ল্যাবরেটরি হোক, বা উচ্চশিক্ষা, বা শিল্প ও কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিজেদের দাবি তুলে ধরতে হয়, নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সঙ্গে রাখতে হয় গোলমরিচের গুঁড়ো। বিষয়টিই যথেষ্ট লজ্জার বলে মনে হওয়া উচিত। কিন্তু না! ততদূর নয় নাই গেলাম, সুবিধা বঞ্ছিত এলাকায় মেয়েদের পড়াশোনার দাবি বা উচ্চশিক্ষার দাবিই এখনও অনর্থক। এখনও কিছু মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকায় গেলে দেখা যাবে পুত্রসন্তানকে ‘আশীর্বাদ’ এবং কন্যাসন্তানকে ‘বোঝা’ মনে করা হয়। সমস্যার সূত্রপাতটা ঠিক কোথায় তার উত্তর হয়তো নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে। সংখ্যায় কম হলেও আজকের দিনে আধুনিক নারীরা সেই সব কিছু পেরিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। সেই সব নারীদের দিকে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে বোঝা কবেই বাবা-মায়ের কাঁধ থেকে নেমেছে। মেয়েদের সাফল্যের  উপার্জন এখন অনেক সংসারের ভরসা। তাই কেবল পুরুষরাই দাতা এবং রক্ষক, সেই ভ্রান্ত ধারণা যে অনেক দিন আগেই ভেঙেছে, অনেকেই তা লক্ষ্য করেনি।

একটু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বৈদিক যুগ থেকে একাধিক মহীয়সী নারী পিতৃতান্ত্রিক ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। পরবর্তীতে, দ্বাদশ শতকে গণিতজ্ঞ ভাস্করের রচিত ‘লীলাবতী’ পড়লে জানা যাবে কন্যারা কীভাবে চিরকাল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে নিজেদের জায়গা করে নিতে উৎসাহী ছিল। ইতিহাসের পাতায় প্রমাণ সহ লেখা রয়েছে ১৯৩০-এর দশকে কমলা সোহোনি প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে প্রাণরসায়নে পিএইচডি অর্জন করেন। তাঁর পথ ধরে জানকী আম্মাল (উদ্ভিদবিদ্যা), অসীমা চ্যাটার্জি (রসায়ন), বিভা চৌধুরী (মহাজাগতিক রশ্মি) এবং আন্না মানি (আবহাওয়াবিদ্যা)-র মতো নারীরা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে অবদান রেখে গিয়েছেন। স্বাধীনতার পর সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। তারপরেও ‘ও তো মেয়ে ও পারবে না’-র দলে ঠেলে দেওয়া হয়েছে হাজারো জনকে।

১৯৫১ সালে উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের সংখ্যা খুব একটা না থাকলেও, বর্তমানে তা প্রায় ৪৮ শতাংশ। যদিও উচ্চ স্তরের গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) কর্মীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা কম (প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ) এবং ‘লিকি পাইপলাইন’-এর সমস্যা এখনও রয়ে গিয়েছে। লিকি পাইপলাইন বলতে বোঝায় কিভাবে অনেক নারী উচ্চ পদে পৌঁছানোর আগেই তাদের অ্যাকাডেমিক জীবন ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু একাডেমিক নয়, কাজই ছেড়ে দিয়েছেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডেক্কান হেরাল্ডে প্রকাশিত একটি খবরে লেখা রয়েছে কর্ম ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষার কারণে ৩৪ শতাংশেরও বেশি মহিলা সংস্থা ছেড়ে চলে যান, যেখানে মাত্র ৪ শতাংশ পুরুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত। এটি একটি কেন্দ্রীয় সমীক্ষার ফলাফল। তাই সেই সব নারীদের আর রাত করে বাড়ি ফেরার প্রশ্নটা শুনতে হয় না।

চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখলে এখনও ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন আইআইটি-র নিয়মিত ডিরেক্টর পদে কোনও নারী নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম জাঞ্জিবারে আইআইটি মাদ্রাজের ক্যাম্পাসের ডিরেক্টর-ইন-চার্জ হিসেবে প্রীতি আঘালায়ম। দেশের শীর্ষ বিজ্ঞান সংস্থায় ফেলোদের মধ্যে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ নারী। যা বোঝায় সমতা আসার পথটা এখনও বেশ লম্বা। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও ব্যবস্থাপনায় সহায়ক এবং দৃশ্যমান মহিলা রোল মডেলের অভাব মহিলাদের এই পথে কেরিয়ার অনুসরণ করতে এখনও নিরুৎসাহিত করে বলে জানিয়েছেন অনেকেই। অন্যদিকে, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, প্রতারক সিন্ড্রোম ও কাজ এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের ভারসাম্য বজায় রাখার অসুবিধাও অনেক বড় বাধা। বর্তমান সামাজিক স্টেরিওটাইপ এবং পক্ষপাত মহিলাদের অংশগ্রহণকে যে চিরকাল সীমিত করে রেখেছে তা বলাই বাহুল্য।

তবে, উইমেন সাইন্টিস্ট স্কিম বা উইমেন ইন সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং- কিরান-এর মতো সরকারি প্রকল্প এই শূন্যস্থান পূরণের লক্ষ্য রাখে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসছে সামাজিক স্তরে—যেসব পরিবার একসময় বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে বারণ করত, তারাই আজ গর্বের সঙ্গে মেয়েদের সাফল্য উদযাপন করছে। আধুনিক নারীদের সাফল্যের উদাহরণ হল মহাকাশ বিজ্ঞানী রিতু কারিধাল ও এম. বনিতা, যারা মঙ্গলযান, চন্দ্রযান-২ এবং চন্দ্রযান-৩-এ নারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। বায়োটেকনোলজিতে কিরণ মজুমদার; ভ্যাকসিন গবেষণায় গগনদীপ কাং; ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে টেসি থমাস (ভারতীয় মহাকাশ প্রকৌশলী এবং অ্যারোনটিক্যাল সিস্টেমের প্রাক্তন মহাপরিচালক এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার অগ্নি-IV ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রাক্তন প্রকল্প পরিচালক); এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইন্দিরা হিন্দুজা (ভারতের প্রথম টেস্ট-টিউব বেবি ডেলিভারি করেন) – এঁরা সাফল্যের নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছেন। শুধু বড় প্রতিষ্ঠানেই নয়, ব্যাঙ্কিং, সরকারি- বেসরকারি চাকরি, এফএমসিজি সেক্টর, দোকান পরিচালনার মতো একাধিক কাজে এখন মেয়েদের দেখা যায়। তাদের সকলের বক্তব্য, নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারের পাশে দাঁড়ানো তাদের কর্তব্য। মফস্বল থেকে শুরু করে টিয়ার ওয়ান শহর, প্রতিটি ঘরের মেয়েরাই এখন জানে সাবলম্বী হওয়ার গুরুত্ব, তা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেক্টরই হোক, বা নিজের ব্যবসা পরিচালনায়। সেখানেই দিন বা রাত, সন্ধ্যা ছ’টা বা রাত ন’টা সময় কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

আজকের দিনে শুধুমাত্র নারী বা কন্যা দিবস পালন নয়, এর যথার্থ মর্ম এবং প্রয়োজনীয়তা বোঝা খুব দরকার। সকলের দেখা উচিত সুযোগ পেলে প্রতিটি মেয়ে কীভাবে একজন সফল বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা বা নেতা হয়ে উঠতে পারে। তবে নারীদের কেবল অন্তর্ভুক্ত করলেই চলবে না, তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। সেই দায়িত্ব যতটা না সুয্যি মামার, তার চেয়ে বেশি সরকারের।