কসাই

পাকা রাস্তাটা রেললাইনে ওঠার আগেই আর একটা কাঁচা রাস্তা এসে তাকে ভেদ করে সোজা উত্তর দিকে তোর্সা নদীতে গিয়ে ঠেকল। এক সময় এই কাঁচা রাস্তাটাই ছিল শহরে ঢোকার প্রধান সড়ক। পাকা রাস্তা থেকে নেমে তোর্সা নদীর দিকে যেতে হাতের ডান ধারে রমজানের মাংসের দোকান। দোকান মানে হাত চারেক একটা বাঁশ পোতা। আর ফুট চারেক গোলাই দেড় ফুট লম্বা একটি শাল কাঠের ডুম, একটি বালতি, ছোট-বড় দুটো দা, একটি চাকু, হাত চারেক একটি পলিথিনের টুকরো আর একটি ইট। বৃহস্পতিবার বাদে সোম থেকে রবি এই ছয় দিনের কোন দিনই বন্ধ থাকে না রমজানের দোকান। বিক্রিও বেশ ভালো। সকাল ছ’টা থেকে বেলা এগারোটা-বারোটার মধ্যেই বেচা কেনা শেষ করে বাড়ি যায়।
প্রথম প্রথম একটা পাঁঠাই শেষ করতে পারতো না বেচে। বেলা বারোটা একটা পর্যন্ত বসে থাকতো। শেষের দিকে কিছু মাংস সস্তায় বেচতে হ’তো তাকে। এতে রমজানের মনে খুব কষ্ট হ’তো। আবার মনে মনে ভাবত ‘যাক কিছুতো এসেছে।’শেষের মাংসটুকুন সস্তায় না বেচলে আসল উঠেও দু’পয়সা লাভ থাকত। এখন শুধু চামড়াটার উপরই যা ভরসা । তাও চামড়ার তেমন দাম নেই আজকাল। রমজান যখন চাচার দোকানে থাকত তখন চামড়ার খুব চাহিদা ছিল। চামড়া নেবার জন্য সকাল থেকে ব্যাপারী এসে বসে থাকতো। বিক্রি হ’তো ইঞ্চি হিসেবে। আর এখন ব্যাপারী আসে না , কসাই তার গোডাউনে গিয়ে দিয়ে আসে। এখন আর ইঞ্চি-টিঞ্চি নেই, একটা মুক্তা দাম ধরিয়ে দেয় খুশি মতো।
এই মন্দার বাজারে সংসার চালাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় রমজানের। রাগটি গিয়ে পড়ে চাচা জব্বার আলীর ওপর। চাচা দোকান থেকে না সরালে এভাবে নাস্তানাবুদ হ’তে হোত না তাকে। পরক্ষণেই ভাবে‘চাচারই বা কি দোষ! চাচা মানুষটি গো-বেচারা। শান্ত প্রকৃতির। চাচিই সব। যেমন চালান তেমনি চলেন। চাচির জন্যই আজকের এই দুরাবস্থা। এর জন্য চাচিই দায়ী।’ এতোদিন এই চাচিই রমজানকে ছেলের মতো করে মানুষ করেছেন। রমজানের যখন বয়স পাঁচ তখন চাচি আমিনার কোলেও এক ছেলে এসেছিল, কিন্তু তার জন্মের পরপরই ইন্তেকাল হয়। তার পরের বছর ফতেমা জন্মে। চাচি চেয়েছিলেন এর পর যেনএকটি ছেলে জন্মায়, কিন্তু পর পর আরও পাঁচটি কন্যা সন্তান উৎপাদনের পর চাচির মন থেকে পুত্রের আশা ক্ষীণ হয়ে গেল। ক্রমান্বয়ে রমজানই চাচির পুত্রের স্থান দখল করে নিল। ছোট থেকে যেমন দেখতে তেমন বুদ্ধিমান ও সল্পভাষী, লাজুক স্বভাবের রমজান যেন চাচা-চাচির নয়নমনি । সবে পনের পেরিয়ে ষোলয় পড়েছে, তাতেই দেখে মনে হয় ও যেন যুবক। রমজানের আব্বাও বলিষ্ঠই ছিল। ও যেন যুবক কালে তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। একদিন আমিনা জব্বারকে বলল, ‘হ্যাঁ গো ফতেমার আব্বু, আমার একটা কথা শুনবে? ———শুনবো না কেন, আমি কি কানে খাটো? ———মশকরা ক’রো না। বল, একটা কথা রাখবে? ———- আঃ তুমি আগে বলতো! ———–আমাদের রমজানের কথা বলছিলাম। ———–রমজানের কথা! সে এমন কি কথা যে আগে কসম খাইয়ে নিচ্ছ? ———–আছে একটা কথা —– ———–আছে তো বলে ফেল। ———–ফতেমাটাও বড় হচ্ছে ——- ———- তুমি কি বলছ, তোমার কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। ———- তোমার কি কোন চিন্তা ভাবনা আছে যে মাথায় ঢুকবে? যত চিন্তা আমার। ———– বলার হয় বল, না হয় বলতে হবে না, বসে বসে চিন্তা কর। আমার এখন সময় নেই। ———– থাক, আমার কথা যখন ভালো লাগে না তো শুনতে হবে না। জব্বার আলী চলে যায়। আমিনারও আর আসল কথাটা বলা হ’লো না। আসলে সঙ্কোচের জন্যই বলতে পারে নি সেদিন। এমনি ভাবে আরও দু’মাস কেটে গেল। মাঝে মনে মনে ভেবেছে ‘রমজানের আম্মার কাছেই কথাটা বলি, আবার ভেবেছে——‘ওর চাচাই তো সব। ওর চাচা যা বলবে আম্মা সেটা উল্টাবে না।’ এদিকে মনের কথাটা না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না আমিনা। একদিন রাতে খাবার খেয়ে জব্বার শুয়ে পড়েছে, আমিনাও খুব তাড়াহুড়ো করে এসে জব্বারের পাশে শুয়ে তাকে একটা আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল ‘ নিন্দ গেছ ফতেমার আব্বু ‘ ?
——না।
—– তোমায় সেদিন যে একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম, কই শুনলে না তো?
—— বল শুনি।
—— রমজানের সাথে যদি আমাদের ফতেমার সাদি দেওয়া যায় কেমন হয়?
—— বলছ কি, তা কি ক’রে হয় !
—— কেন তা তো অনেকেরই হয়। চাচাত-জ্যাঠাত ভাই বোনের সাদিতে শরিয়তে কোন নিষেধ নাই।
——- তা নাই, তবে—-
——- না, আর কোন তবে-টবে বোলো না। কোথাকার কোন অজানা-অচেনা ছেলের হাতে পড়বে, সে কেমন হবে বলতে পারবো?

   ফতেমা জব্বার আলীর প্রথম সন্তান। তাই ওর প্রতি দরদটা একটু বেশি। জব্বার আলী চট্ করে হ্যাঁ না কিছু না বলে বলল, 'ভাবীর সাথে আলাপ করে দেখ কি বলে ' । 
     পাঁচ সাত দিন কেটে গেলেও প্রস্তাবটা আর দিতে পারে নি আমিনা। সুযোগ হয়ে উঠে নি। এর মধ্যে রমজানের মা এক দিন তার বোনের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে দেওয়রকে বলল----'রমজানের সাদির জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে, মেয়েটি খুবসুরত। ওদের বংশ পরিচয়ও ভালো। তোমরা একদিন গিয়ে দেখে আস। 
   'তুমি দেখেছ? ' বলল জব্বার। 

—–হ্যাঁ, দেখেছি।
——-তোমার মত কি?
——- আমার আবার কি মত? তুমি যা বলবে সেটাই হবে। লেড়কির আব্বাজানকেও আমি সেই কথাই বলেছি। জব্বার আলী হ্যাঁ না কিছু বলে নি।

      ওই মিঞা সেদিন রমজানের মাকে জোর ক'রে ধরে বলল, 'আপনি কথা দেন, ব্যাটার চাচাকে আমি মত করাব। জব্বার আলী আমার কথায় অমত করবে না। আমার বেটিকে দেখে কি আপনার পছন্দ হয় নাই? ' 

  ----আপনার বেটিতো খুবসুরত। যে দেখবে সেই  পছন্দ করবে। আপনি বড়লোক, আমরা সাধারণ মানুষ। আমার বেটা আপনার বেটির ভরণ পোষণ দেবে কি ভাবে! 
  -----আপনার ব্যাটার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে   দেন। 
  এর পর একদিন বড়লোকের মেয়ের সাথে রমজানের সাদি হয়ে গেল। বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই বিবি আর আম্মাকে দিয়ে ভিন্ন করে দিল রমজানকে। 

 রমজানের চাচার দোকানেও এখন বসতে হয় না। রমজান মনমরা হয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় । বাড়িতেও মন টেকে  না। এই সব খবর পেয়ে তার শ্বশুর তাকে ঘর জামাই নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলো। রমজান রাজী হয়নি। টাকা পয়সা দিয়ে ভালো কারবার ধরিয়ে দিতেও চেয়েছিল, কোনটাতেই ঘাড় পাতেনি রমজান। পরের দান তার পছন্দ না। কার কাছ থেকে যেন ধারে কিছু টাকা নিয়ে এই কাঁচা রাস্তার ধারে মাংসের দোকান খুলে বসেছে। রমজান খুব সকালে উঠে দোকানে যায় একটা পাঁঠা নিয়ে। বাঁশের খুঁটির সাথে পাঁঠাটাকে বেঁধে রেখে চৌপথি সংলগ্ন পাকা রাস্তার ধারে বিজয়ের চায়ের দোকান থেকে নিজের দোকানের সরঞ্জাম ও এক বালতি জল এনে তাড়াহুড়ো করে দোকনটা সাজিয়ে ফেলে। দোকান সাজানো মানে প্রথমে ভালো ক'রে ঝাঁট দিয়ে জল ছিটিয়ে পলিথিনটা পাতে, তার উপর ছুরি দুটো রাখে। নিদিষ্ট জায়গায় কাঠের ডুমটা ও বসার জন্য ইটটাকে রেখে পাঁঠাটাকে একটু দূরে জবাই করে এনে বাঁশে ঝোলায়। ধীরে ধীরে রমজানের মাংসের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। আশ্বিন মাস। এখন আর মাংস নিয়ে ফিরে যেতে হয় না। একটার জায়গায় দুটো, কোন কোন দিন তিনটে পাঁঠাও শেষ হয়ে যায় তার। 

    রমজান যেখানে দোকানটা করেছে তার চারদিকেই হিন্দু বসতি। একদিন ক্লাবের ছেলেরা এসে রমজানের হাতে একটা দুর্গা পূজার রসিদ ধরিয়ে দিয়ে গেল। রমজান পড়ে দেখে একশ একান্ন টাকা লেখা। রমজান ক্লাবের ' দাদা'দের স্মরণাপন্ন হয়ে তার অক্ষমতার কথা জানিয়ে একান্ন টাকা নিতে অনুরোধ করল। কিন্তু রমজানের অনুরোধ দাদাদের কঠোর মনকে স্পর্শ করতে পারলো না। রমজান পুজোর মধ্যেও দু-এক দিন ক্লাবে গিয়ে চাঁদা সাধলো। দু'এক জন বলেছে 'তোকে চাঁদা দিতে হবে না।'
  পুজো শেষে এলো বিজয়াদশমীর দিন। এদিন রমজান একটি খাসি ও দুটি পাঁঠা কেটেছে। ক্লাবের  ছেলেরা তিন কিলো খাসির মাংস নিল পিকনিক খাবে বলে। মাংস হাতে নিয়ে বলে আসলো 'দামটা ক্লাব থেকে নিয়ে আসিস। 'রমজান দোকান শেষে ক্লাবে গেলে ক্লাব সেক্রেটারি ওর হাতে এক কিলো মাংসের দাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'তোর এক কেজি চাঁদা আর এক কেজি ফাইন । এর পর যেন আর ফাইন দিতে না হয়, মনে থাকে যেন। ... যা বেটা কসাই। '
         রমজান মনে মনে বলল 'আমি মাংস বেচি বলে আমি কসাই! আর তোমরা... 
                                                                                 ............সন্তোষ দে সরকার