গিগ অর্থনীতি ও উত্তরবঙ্গের বাস্তবতা: সম্ভাবনা ও সঙ্কটের দোলাচল

সাগ্নিক চক্রবর্ত্তী, ইতিহাস গবেষক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির পরিধিতে এক নতুন কর্মসংস্থানের ধারণা দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, যার নাম গিগ অর্থনীতি। গিগ অর্থনীতি বলতে এমন এক শ্রমব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে অল্প সময়ের জন্য, নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপের মাধ্যমে আয় করা হয়। এখানে কর্মী ও নিয়োগকর্তার সম্পর্ক স্থায়ী নয়, বরং কাজভিত্তিক বা প্রকল্পভিত্তিক। উবার, র‍্যাপিডো, জোম্যাটো, সুইগি, অ্যামাজন, আপওয়ার্ক, ফাইভার প্রভৃতি সংস্থা বা প্ল্যাটফর্ম এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে এই গিগ মডেল কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়ালেও, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছে।

উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ও সীমিত শিল্পভিত্তিক। সরকারি চাকরির উপর অতিনির্ভরতা এবং বেসরকারি উদ্যোগের ঘাটতির কারণে যুবসমাজের বড় অংশ দীর্ঘদিন বেকারত্বের জালে আটকে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্মার্টফোনের প্রসার, ইন্টারনেট সংযোগের উন্নতি ও ডিজিটাল সাক্ষরতার বৃদ্ধির ফলে গিগ অর্থনীতি উত্তরবঙ্গেও প্রবেশ করেছে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদা, আলিপুরদুয়ার, সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে অসংখ্য তরুণ ও তরুণী আজ ডেলিভারি পার্টনার, রাইড শেয়ার ড্রাইভার, অনলাইন টিউটর, কনটেন্ট রাইটার, গ্রাফিক ডিজাইনার বা সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। এতে একদিকে বেকার যুবকদের জন্য নতুন আয়ের পথ তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে স্বল্প মূলধনেই আত্মনির্ভরতার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

নারীশক্তির অংশগ্রহণও এখানে লক্ষণীয়। অনেক নারী গৃহস্থালির দায়িত্ব পালন করেও ঘরে বসে অনলাইন ফ্রিল্যান্স বা কনটেন্ট সংক্রান্ত কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এতে আর্থিক স্বনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই উজ্জ্বল দিকের আড়ালেই রয়েছে এক গাঢ় অন্ধকারও, এই কাজগুলির অধিকাংশই অনিশ্চিত, অস্থায়ী এবং সুরক্ষাহীন। নেই কোনো স্থায়ী চাকরির নিশ্চয়তা, নেই সামাজিক নিরাপত্তা, পেনশন, চিকিৎসা সুবিধা কিংবা ছুটির অধিকার। ফলে গিগ শ্রমিকেরা (যদিও গিগ অর্থনীতিতে তারা পার্টনার, শ্রমিক নয়, যেকারনে তারা অনেকাংশে শ্রমিক হিসেবে আইনি অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়। ) এক অদৃশ্য অনিশ্চয়তার ভেতরে কাজ করেন, যেখানে আয় নির্ভর করে অ্যাপের অ্যালগরিদম, বছরের বিশেষ সময়, কিংবা গ্রাহকের উপর।

এছাড়া ডিজিটাল বিভাজনের (digital divide) কারণে উত্তরবঙ্গের অনেক গ্রামীণ তরুণ এখনও পিছিয়ে আছেন। যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, তারাই ভালো আয় করতে পারছেন, অথচ সাধারণ কর্মীরা কম পারিশ্রমিকের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। এই বৈষম্য ভবিষ্যতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দক্ষিণবঙ্গে যেমন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গিগ প্ল্যাটফর্মভিত্তিক আয়ের প্রবণতা বেড়ে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ কিছুটা কমে গেছে, তেমন প্রভাব উত্তরবঙ্গেও ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করেছে। অনেক তরুণ এখন উচ্চশিক্ষা বা দীর্ঘমেয়াদি পড়াশোনার বদলে দ্রুত উপার্জনের পথে হাঁটছেন। এতে একদিকে তাৎক্ষণিক আয় সম্ভব হলেও, দীর্ঘমেয়াদে কর্মদক্ষতা ও জ্ঞানের বিকাশে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

তবুও সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। যদি সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, ন্যায্য পারিশ্রমিক কাঠামো এবং শ্রমিক কল্যাণমূলক নীতিমালা প্রবর্তিত হয়, তবে গিগ অর্থনীতি উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, গিগ অর্থনীতি উত্তরবঙ্গের তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন এক কর্মসংস্থানের যুগে এনে দিয়েছে, যেখানে স্বাধীনতা আছে কিন্তু স্থায়িত্বের অভাব, সুযোগ আছে কিন্তু সুরক্ষার ঘাটতি। এই দোলাচলের মধ্য দিয়েই আগামী দিনের উত্তরবঙ্গ নির্ধারণ করবে, এখানকার তরুণরা কেবল অস্থায়ী কর্মী হয়ে থাকবে, নাকি নীতিগত সুরক্ষা এবং সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডিজিটাল যুগের নতুন, সুরক্ষিত ও স্বাবলম্বী উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে।