স্কুল পাশ করা ছেলেগুলো কলেজে উঠেছে। সেই কোন কালে মধুবাবু মানে মধুসূদন বর্মন পাড়ায় ক্লাবটা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলো, উনি তো এপাড়ার লোক নন। উচ্চশিক্ষিত লোক, কারখানার কাজের অবসরে সমাজ সেবা করে বেড়াতেন। সেই সুবাদেই এ পাড়ায় নবারুন ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । উনি মহৎ উদ্দেশ্যে করে ছিলেন। পাড়ার মানুষের আপদে বিপদে সবাই সবার পাশে থাকার একটা প্রবণতা থাকে, সে জন্য ক্লাব গড়ে ছিলেন। উনি তো ইহজগত বেশ কয়েকবছর আগে ছেড়েছেন,তবে তার ক্লাব স্বমহিমায় আছে।
তরুন প্রজন্মের প্রচেষ্টায় নবারুন ক্লাব দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কিন্তু দুষ্টুমিতে কম যায়না। নবারুন ক্লাবে তপন, গৌতম, রাজীব, অরুন, গোকুল ছাড়াও অরো অনেক সদস্য আছে। প্রত্যেকেই বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলে। খেলার শেষে পাড়ার কালভার্টের এসে বসে। তখনই তাদের মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধির উদয় হয়। রামহরি বাবু তার বাগানের পেয়ারা কোন দিনই খেতে পান না। দুপুরে নয়তো একটু রাতের দিকে তার বাগানে ক্লাব হাজির। সব পেয়ারা তুলে এনে ক্লাবে রাখা হয়। সব সদস্যই খাবার সুযোগ পায়। এমনও হয়েছে, রামহরি বাবুর ছেলে মানস, সেও ভাগ পেয়েছে। সন্দেহ জাগতেই সেও প্রশ্ন তুলেছে, ‘কিরে গোকুল এ পেয়ারা মনে হচ্ছে আমাদের গাছের।’ গোকুলের উত্তর, সবার যেমন দেয়,একই ধাচের,’ কি যে বলিসনা, তোর গাছের পেয়ারার মতন পেয়ারা কি অন্য গাছে হতে পারেনা। এতো শেষের লাইনের সুমনদের গাছের পেয়ারা।’ এভাবেই তাদের প্রতি ঘণ্টায় কিছু না কিছু দুষ্টুমি ছিলো, সেটা নির্ঝঞ্জাটে মিটে যেতো।
পাড়ার দেবাশীষদা, ভীষণ নিরীহ গোবেচারা মার্কা ছেলে। চার বোনের এক ভাই।বাড়ীতে সবাই আতুতুতু করে রাখে, ক্লাবে যায়না। ক্লাবের সব ছেলের সাথে মেশেনা। সেজন্য সে ক্লাবের ছেলেদের সুনজরে ছিলনা। স্কুলে পড়ার সময়েও ওর দিদিরা ওকে পৌছে দিতো। হাই স্কুলে পড়ার সময় একাই যেতো, তবে মাঝে মাঝে তপনের সঙ্গ নিতো। ক্লাবের সেক্রেটারি অরুনদা অনেকবার দেবাশীষকে বলে ছিলো, ক্লাবের সদস্য হয়ে যেতে, কিন্তু হয়নি। দেবাশীষের একটাই উত্তর,’ তোরা বদমাইশি করবি আর আমাকে ফাঁসিয়ে দিবি। তোদের আমি চিনিনা।’ এসবের জন্য দেবাশীষের পিছনে ঐ ক্লাবের সদস্যরা মজা করে অনেক কিছু বলতো। কিন্তু ও তো কিছু বলতোনা , তাই ঝগড়াও হতোনা।
এ শহর ঘিরে কোলিয়ারি আর কোলিয়ারি। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম পড়ে। পাড়ার মানুষ তাদের ডেরা গুলিতে আর শুতে পারে না। অধিকাংশ ছেলেরা গরম কালে বাইরে ফোল্ডিং কটে ঘুমোয়। অনেকেই আবার ফোল্ডিং কট নিয়ে খোলা যায়গায় বা রাস্তার পাশে ঘুমোয়। শান্তিতে ঘুমোতে পারে। দেবাশীষদার ভীষণ ভয়, ওদের বাড়ীর কেউ বাইরে ঘুমোয় না। পাড়ার সবাইকে দেখে, দেবাশীষদার ভীষণ ইচ্ছে, রাস্তার পাশে ফোল্ডিং কটের উপর ঘুমানো। বাড়ীর লোকেরা ওকে কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সে বাড়ীতে মা বাবা দিদিদের কাছে অনেক জোরাজুরি করাতে গত তিন দিন ধরে দেবাশীষদা রাস্তার পাশে ফোল্ডিং কট পেতে ঘুমোয়। এ খবরটা ওদের পাশের বাড়ীর ছেলে ফুকুনের মাধ্যমে ক্লাবে চাউর হয়ে গেল।
পরের দিন ফুটবল খেলা শেষে, কালভার্টে বসে আড্ডার সময় ঠিক হয়ে যায় – আজ রাতে বারটার সময়,আগুপিছু হতে পারে , ক্লাবের চার জন মিলে ফোল্ডিং কট সহ দেবাশীষকে তুলে বড় রাস্তার পাশে যে মাঠটা আছে, সেখানে রেখে আসা হবে। কোন চারজন একাজ করবে তাও বলে দেওয়া হলো। পরিকল্পনা মতো ক্লাবের ছেলেরা রাত বারোটা নাগাদ দেবাশীষদাকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে ফিরে এলো। ঐ জায়গাটা পাড়ার থেকে একটু দূরে, ফাঁকা জায়গা। ঐ অঞ্চলে খুব একটা জনবসতি ছিলনা। ঘুমন্ত অবস্থায় নিয়ে যাবার সময় দেবাশীষের ঘুম ভাঙ্গেনি। কাজটা খুব সন্তর্পনে করেছিলো।
ভোরবেলায় পাড়ার লোকেরা খুব ব্যস্ততার মধ্যে থাকে। ঘড়ির কাটায় সকাল সাড়ে ছটা বাজলেই কারখানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হয়। এর মধ্যে দেখা গেলো, দেবাশীষের বাড়ীর সামনে জটলা। দেবাশীষের মা দিদিরা কান্নাকাটি করছে। পাড়ার লোকেরা জানতে পারে যে দেবাশীষকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে সে ফোল্ডিং কট নিয়ে রাস্তার পাশে শুয়ে ছিলো। কারখানার যাত্রীরা বড় রাস্তার একটা ফোল্ডিং কট পড়ে থাকতে দেখে।তারা এসে দেবাশীষের বাড়ীতে খবর দিয়ে গেছে। বাড়ীর লোকেরা সেখানে গিয়ে তাদের ফোল্ডিং কটটা সনাক্ত করলো। এবার তো ওদের বাড়ীতে আরো কান্নার রোল পড়ে গেলো। আত্মীয় স্বজন পাড়াপড়শী এসে দেবাশীষদার মা দিদিকে সান্তনা দিতে লাগলো। পাড়ার কিছু লোক ও দেবাশীষদার আত্মীয়স্বজন, দেবাশীষদার বাবাকে নিয়ে থানায় গেলো।
এ শহরের থানা নবারুণ ক্লাব বেষ্টিত পাড়াগুলো থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। দেবাশীষদার বাবা পুলিসে ডাইরি করলো। পুলিস দেবাশীষদার সম্বন্ধে নানা খোঁজখবর নিলো। যেগুলো তাদের এক্তিয়ারে পড়ে। থানার বড়বাবু বলল,’ দেখুন যারা আমাদের নাইট পেট্রোলিংয়ে ছিলো, তারা বাড়ী চলে গেছে। আমরা তাদের কাছ থেকে খোঁজ নিচ্ছি। তারপরে আপনাদের বাড়ী যাবো। বাড়ীর ঠিকানাটা ঠিক করে লিখেছেন তো।’ বড়বাবুর কথা মতো সকলেই বাড়ী ফিরে এলো।
ঘণ্টা দুয়েক পর বড়বাবু আর দুজন কন্সটেবল সহ দেবাশীষের বাড়ীতে এলো। পুলিসের গাড়ী দেখে পাড়ার লোকেরা তাদের বাড়ীর কাছে জমায়েত করলো। বড়বাবু বাড়ীর ও পাড়ার সকলের সামনেই বললো,’ দেখুন আমার লোকেরা যখন রাতে পেট্রোলিং এ ছিলো, সেই সময় আপনাদের ঐ বড় রাস্তার পাশে, খাটিয়ায় কটের উপরে একজনকে গোঙাতে দেখতে পেয়েছিলো। তখন তারা গোঙানির আওয়াজ শুনে গাড়ী থামিয়ে কটের কাছে গিয়ে দেখে একজন কাঁপছে আর গোঙ্গাচ্ছে । সঙ্গে সঙ্গে তারা ছেলেটিকে তুলে সোজা ধানবাদে রাজ্য সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা তো আর রাস্তায় পরে থাকা লোককে আপনাদের কারখানার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনা। ওখানে ছেলেটিকে ভর্তি করা হয়েছে।এই চিরকুটটায় বেড আর ওয়ার্ডের নম্বর লেখা আছে। হাসপাতালে এমার্জেন্সিতে গিয়ে আমাদের পুলিস স্টেশানের কথা বললেই কোথায় ভর্তি আছে বলে দেবে। হাসপাতাল থেকে বলেছিলো,আজ বিকেলে বা কাল সকালে ছেড়ে দিতে পারে । এবার দেখুন গিয়ে, ডাক্তারবাবুরা কি বলে। আপনাদের একবার ধানবাদ গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কাল দুপুরে এসে আপনার ছেলের সাথে কথা বলে কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে মাঠে রেখে এসেছিলো তার তদন্ত করবো।’
দারোগা বাবু বেরিয়ে যেতেই পাড়ায় হুলুস্থুলু পড়ে গেল। কার ছেলেরা একান্ড করেছে। পুলিস তো ছাড়বেনা। সবকটাকে ধরে নিয়ে যাবে। বিকেল হতেই দুই মেয়েকে নিয়ে সরকারবাবু মানে দেবাশীষের বাবা ধানবাদ হাসপাতালে গেলো। রাত আটটা নাগাদ বাড়ীতে ফিরলো। পাড়ার সবাই এসে একবার দেবাশীষদাকে দেখে গেল। ক্লাবের ছেলেরা তো ভয়ে অস্থির। গোকুলকে সবাই গালাগালি করতে লাগলো। অসিত তো বললো,’ তুই প্রথম শুরু করেছিলি, যে দেবাশীষটাকে আজ রাতে মাঠে রেখে আসবো। তারপর তো আমরা তোর সাথে যোগ দিলাম।’ অনুপদা ক্লাবের সেক্রেটারি একটু গম্ভীর প্রকৃতির লোক, বললো, ‘ বড় বাবুর সঙ্গে কথা বলে দেখি কি করা যায়। দেখলি তো হাসি মশকরা সব ভালো। কিন্তু একটা সীমার মধ্যে। ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশন, কত কি হয়ে গেল। ভবিস্যতে এ ধরনের কাজ যেন কেউ না করে। ছোট্ট ব্যাপারটা সাতকাহন হয়ে গেল। এখন দেখি দেবাশীষের বাবা পুলিসকে কি বলে।’
পরের দিন বড়বাবু চারজন কনস্টেবল নিয়ে ভ্যানে করে এলো। আসামীদের ধরে নিয়ে যাবে। তারা এসে দেবাশীষদার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানলো। পুলিশ বুঝতে পারলো – এব্যাপারটা নবারুন ক্লাবের ছেলেদের কাজ। পুলিশ আসতেই অনুপদাও দেবাশীষদার বাড়ীর সামনে দাড়ালো। দেবাশীষদার বাবাকে বড়বাবু বললো,’ ক্লাবের কয়েকটা ছেলের নাম বলুন, ভ্যান এনেছি, ধরে নিয়ে চলে যাবো। সবাই দেখলো , দেবাশীষের বাবা করজোরে বললো,’ দারোগাবাবু, এ কাজটা করবেন না। ওরা আমার পাড়ারই ছেলে, আমার ছেলেরই মতো।’ বড়বাবু বললেন,’ ঠিক আছে আপনি যখন বলছেন আর কেস কিছু করছিনা। এই পাতাটায় হস্তাক্ষর করে দিন। কেসটা ডিসমিস হয়ে যাবে।’
বড়বাবু তার দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনুপদা গিয়ে ক্লাবের পক্ষ থেকে দেবাশিষের বাবার কাছে ক্ষমা চাইল, বললো ‘ কাকু, আপনার মহাণতা আমাদের অনেক শিক্ষা দিল। চিরকাল এ কথা ক্লাবের সকল সদস্য মনে রাখবে।’