মুখোশের খেলা

1 min read

“সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।”

এই কথাটার সঙ্গে আমরা কম বেশী সকলেই পরিচিত।সুন্দর মুখ বলতে আমরা আপাতদৃষ্টিতে যা বুঝি তা কি আদৌ সুন্দর?অনেকেই বলবেন ঈশ্বর যার মুখশ্রী সুন্দর করে পাঠিয়েছেন তাকে সুন্দরই তো বলব।এখন প্রশ্ন হল মুখের শ্রী বলতে কি বোঝায়?আজকাল অতি আধুনিক যুগে নিমেষের মধ্যে যন্ত্রের সৌজন্যে সকলেই সুন্দর হয়ে ওঠে।সেই মেকী ছবি দেখতে- দেখতে বেশীরভাগ মানুষ একপ্রকার আত্মরতি লাভ করে।কেবল নিজেকে ভালবাসা বা নার্সিসিজম!নিজের সাজানো মিথ্যে মুখের মুখোশটা সকলের সামনে তুলে ধরার এক নেশা পেয়ে বসেছে যেন আমাদের!কিছুতেই আসল আমিটাকে,
সত্যিকারের মুখটাকে কারো সামনে দেখাতে চাইছি না আমরা।কিন্তু এই মেকী মুখোশের আড়ালে সত্যিই কি মুখটাকে লুকিয়ে রাখা যায়?

কেন আমরা আসল মুখটাকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখছি?অন্য মানুষের কাছে মহান হবার,মহৎ হবার চেষ্টা করছি?আসলে আমরা ভুলে যাচ্ছি এইভাবে মহান বা মহৎ সাজা যায় না।কথায় বলে-

  • যা চকচক করে তাইই সোনা নয়।”

আমরা চকচকে জিনিসকে সোনা ভেবে ভুল করি মাত্র।গিল্টি করা গয়নার রঙ উঠে দুদিন বাদে যেমন সে গয়নার আসল চেহারাটা বেরিয়ে যায়,তেমনি সময়ে মানুষের মিথ্যে সাজানো মুখোশটা ছিঁড়ে আসল মুখের চেহারাও বেরিয়ে পড়ে।

    মুখোশ কি?নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য, নিজেকে সততার প্রতীক রূপে তুলে ধরার জন্য যে ছলা- কলা, মিথ্যে অভিনয়, স্বার্থপরতা দিয়ে নিজেকে মুড়ে ফেলি আমরা,অন্য মানুষদের ভাবনার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিই, তাই হল মুখোশ।এই মুখোশ অনেক সময়ই অনেক মুখোশহীন সরল, বিশ্বস্ত মানুষদের ধোঁকা দেয়।তারা যন্ত্রণা পায়, দুঃখ পায়!তাদের কাছে জীবনটা দুর্বিষহ বলে মনে হয়।তখন তারাও কিন্তু সে দুঃখগুলোকে মিথ্যে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে চায়।

তাহলে আমরা বলতে পারি একজন মুখোশ পরে অন্যজনকে ঠকায় আর অপর পক্ষ মুখোশ পরে তার ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণাটা আড়াল করে।এই হল মুখ আর মুখোশের খেলা।তাই অনেক সময়ই আমরা যেসব সুন্দর মুখ দেখে বিভ্রান্ত হই তেমনই তা যে মেকী মুখোশের কারিগরী তা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়।

      বর্তমান যুগ হল এই মুখ আর মুখোশের দ্বন্দ্বের যুগ।একটা খুব সহজ উদাহরণ দেওয়া যায়।ফেসবুক বা মুখবইয়ের দৌলতে এখন আমাদের অসংখ্য বন্ধু।যারা বেশীর ভাগই তাদের কদর্য মুখটা সুন্দর মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখে।তারা যখন হাজার- হাজার লাইক কমেন্টস করে তখন মনে হয় সত্যি এমন বন্ধু হয়তো আর কোথাও পাওয়া যাবেনা।কিন্তু যখন সত্যিকার প্রয়োজন হয় তখন মুখোশ ছিঁড়ে সেইসব বন্ধুদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।
চাণক্য শ্লোকে আমরা পড়েছি-

” মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে হৃদয়ে তু হলাহলম্।”

মুখে মিষ্টি- মিষ্টি কথা আর মুখোশের আড়ালে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকে বিষাক্ত মনটা।এই বিষাক্ত মন আসলে ধ্বংস ডেকে আনে।মানবতার ধ্বংস,মানুষের সাথে মানুষের সুন্দর সম্পর্কের ধ্বংস,মঙ্গল চিন্তার ধ্বংস।আজকাল এই মুখ আর মুখোশের বেড়াজালে আমরা নিমেষে জড়িয়ে পড়ি।সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্বে জীবন থেকে শুভবোধ হারিয়ে যায়।

   আজকাল আমরা মুখগুলোকে কর্পোরেট সৌজন্যতার মুখোশে ঢেকে ফেলেছি।এখন মাঝে- মাঝেই মনে পড়ে সেই অমোঘ উক্তি-

“পৃথিবীর সমস্ত মানবিক সম্পর্কই অর্থমূল্যে বিচার্য।”

কথাটা শুনতে খুব খারাপ লাগে।মনে হয় এমন আবার হয় নাকি?হয়, হয়—লোভ, ক্ষমতা, অর্থ মানুষের মানবিক মুখগুলোকে,রক্তের সম্পর্কগুলোকেও কালিমালিপ্ত করতেও পিছপা হয়না।

আবার উল্টোদিক থেকে দেখলে এই জীবনেই মুখোশের আড়াল থেকে ধ্রুবতারার মত উজ্জ্বল এক একটা সত্যিকার সুন্দর মুখ আমরা অনেকসময় খুঁজে পাই।আর যারা পায় তারা অতি ভাগ্যবান।সেই সুন্দর মুখকে স্নেহ, ভালবাসা, বিশ্বাসের মুখোশে সারাজীবন যেন ঢেকে রাখা যায় সেই প্রচেষ্টাই করা উচিত।

      পরিশেষে বলা যায় আমাদের মন আর মুখ যতদিন না আমরা এক করতে পারবো ততদিন মিথ্যে মুখোশের মায়ায় ব্যর্থ হবে জীবনের আসল উদ্দেশ্য।তানাহলে আমরা মানুষের হৃদয়ে কোনো দাগ রেখে যেতে পারব না।

হিংসা, পরশ্রীকাতরতা,ঘৃণা,ক্ষমতার লোভ, দম্ভ এসব নীচতাই লুকিয়ে থাকে আজকাল মুখোশের আড়ালে।সেই সত্য, শিব, সুন্দরের মঙ্গলময় মুখটি বিষাদের কালো ধোঁওয়ায়,মিথ্যার ঘন কুয়াশায় আজ আচ্ছন্ন।সেই সরলতা দিয়ে গড়া মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা শিশুটা কোথায় যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানিনা।মেকী সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর দেখনদারির জগতে সেই নিষ্পাপ সরল ভালবাসা মাখা মুখটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।তাই আমরা সকলেই সব মেকী মুখোশ ছিঁড়ে সত্যিকার সুন্দর মুখ খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না কিছুতেই।মুখ আর মুখোশের গোলকধাঁধায় কেবলই ঘুরছি।

You May Also Like